বরিশাল সিটি নির্বাচন

এবারও কি বাসদের মেয়র প্রার্থী হবেন মনীষা

মনীষা চক্রবর্তী
ছবি: সাইয়ান

আসন্ন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) অংশ নেবে কি না, এ নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে বরিশালে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নির্বাচনকেন্দ্রিক কমবেশি তৎপরতা থাকলেও বাসদের একেবারেই নেই।

২০১৮ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বাসদ প্রার্থী দিয়েছিল। দলটির প্রার্থী হিসেবে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন জেলা বাসদের সদস্যসচিব চিকিৎসক মনীষা চক্রবর্তী। তবে এবার কে প্রার্থী হচ্ছেন, তা নিয়ে কারও কারও আগ্রহ ও কৌতূহল আছে।

গত সিটি নির্বাচনে মনীষা চক্রবর্তী আলোচনায় এসেছিলেন মাটির ব্যাংকের টাকায় নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে। ওই সিটি নির্বাচনে প্রথম কোনো নারী প্রার্থী হিসেবে মনীষা মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাঁর নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়াটি মানুষের বেশ নজর কেড়েছিল। মাটির ব্যাংকে সাধারণ মানুষের জমানো টাকায় চলেছিল তাঁর নির্বাচনী কার্যক্রম।

বাসদের জেলা আহ্বায়ক ইমরান হাবিব বলেন, বাসদের দলগতভাবে এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তবে নির্বাচনে অংশ নিলে মনীষা চক্রবর্তী মেয়র পদে দলের পক্ষ হয়ে লড়বেন, এটা নিশ্চিত।

দলটির নেতারা বলছেন, বাসদ দলগতভাবে এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মনীষাই মেয়র পদে দলের পক্ষ হয়ে লড়বেন। এ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি তাঁদের রয়েছে। ২০১৮ সালে বরিশাল সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন মনীষা। ভোটের দিন অনিয়মের প্রতিবাদে দুপুরে নির্বাচনে বর্জন করেন তিনি। তবে ভোট শেষ হলেও মাঠ ছাড়েননি। নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে মনীষা বরিশালবাসীর কাছে ইতিবাচক আলোচনার কেন্দ্রে আছেন।

মনীষা চক্রবর্তী আলোচনায় আসেন ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও তিন চাকার যান চলাচলের বৈধতা দিতে রাজপথে আন্দোলন–সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে। একই সঙ্গে বরিশাল নগরের প্রান্তিক মানুষের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে রাজপথে কয়েক বছর ধরেই সক্রিয় বাসদের এই নেত্রী। ব্যাটারিচালিত রিকশা উচ্ছেদের প্রতিবাদে ২০১৮ সালের ১৯ এপ্রিল শ্রমিকেরা বরিশাল নগরে মিছিল বের করেন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন মনীষাও। সেদিন পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া মামলায় কারাবাসের পর একই বছরের ২৬ এপ্রিল জামিনে ছাড়া পান তিনি। ঘটনাটি দেশজুড়ে বেশ আলোচিত ছিল।

জেলা বাসদের সদস্য সন্তু মিত্র বলেন, ৩৪তম বিসিএসে স্বাস্থ্য ক্যাডারে নিয়োগ পান মনীষা চক্রবর্তী। কিন্তু সরকারি চাকরিতে যোগ না দিয়ে তিনি রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত রয়েছেন। তিনি বিনা পয়সায় গরিব মানুষকে চিকিৎসা দেন, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে থাকেন। শ্রমিকদের মধ্যে জনপ্রিয় তিনি। মনীষার দাদা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, বাবাও মুক্তিযোদ্ধা। পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেও তাঁকে নিয়ে আগ্রহ আছে মানুষের।

করোনাকালের শুরুতে মনীষা মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের পাশাপাশি শুরু করেন চিকিৎসাসেবা, সচেতনতা কার্যক্রম, খাদ্যসহায়তা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহায়তাসহ বহুমুখী কাজ। জরুরি রোগীদের হাসপাতালে নেওয়ার জন্য প্রথমে ১০টি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাকে অ্যাম্বুলেন্সে রূপান্তর করেন এবং পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ একটি অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করে রোগী পরিবহনের ব্যবস্থা করেন। এ কর্মসূচির নাম দেন ‘ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস’। ‘নির্ভয়’, ‘আস্থা’, ‘নির্ভীক’ ইত্যাদি নামে বরিশালজুড়ে গরিব রোগীদের সেবা দেয় অ্যাম্বুলেন্সগুলো। এসব কাজ করার জন্য গঠন করেন ২০ জনের একটি স্বেচ্ছাসেবী দল। রোগীদের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে অক্সিজেন–সহায়তার জন্য খোলেন অক্সিজেন ব্যাংক। এই কর্মসূচির নাম দেওয়া হয় ‘ফ্রি অক্সিজেন ব্যাংক’। ১৫টি অক্সিজেন সিলিন্ডার, ৬০টি অক্সিমিটার দিয়ে এই সার্ভিস চালু করেন মনীষা ও তাঁর সহযোগীরা।

কারোনাকালে খাদ্যসংকটের কথা বিবেচনা করে মনীষা চক্রবর্তী ও তাঁর সহযোগীরা ‘আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাঁচুক প্রতিটি মানুষ’—এমন স্লোগানে খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি ‘একমুঠো চাল’ সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেন। এক হাজার বাজারের ব্যাগ তৈরি করে নগরের বিভিন্ন বাড়িতে সরবরাহ করেন মুষ্টি চাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী।

করোনাকালে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর আর্থিক সংকটের কারণে তাঁদের সহায়তার জন্য বাড়ি বাড়ি মুষ্টি চাল সংগ্রহ করে তা মানুষের মধ্যে বিতরণে উদ্যোগ নেন। নগরের ফকিরবাড়ী সড়কের মাতৃছায়া স্কুলমাঠে চালু করেন ‘মানবতার বাজার’ নামে একটি বাজার। এই বাজার থেকে মাস্ক, ওষুধ, চাল, ডাল, তেল, আলু, আটা, লবণ, বিভিন্ন সবজি, ডিমসহ ১৭টি খাদ্যপণ্য বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়।

বাসদের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক ফ্রন্টের জেলা সাধারণ সম্পাদক দুলাল মল্লিক বলেন, বরিশাল  নগরের ৩০টি ওয়ার্ডে দলটির শ্রমিক সংগঠনের শক্তিশালী কমিটি রয়েছে। এসব কমিটি যেকোনো পরিস্থিতিতে দলের হয়ে কাজ করছে। ফলে নির্বাচনে তাদের আলাদা করে কোনো প্রস্তুতি নেওয়ার কিছু নেই।

বরিশাল নগরে মানবিক, সামাজিক ও অধিকার আদায়ে মাঠে থাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে মনীষা চক্রবর্তীর আলাদা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন বাসদের নেতা-কর্মীরা। বিশেষ করে নগরের ১০ হাজার ব্যাটারিচালিত যানবাহনের চালক ও শ্রমিক ঘিরে তাঁর আলাদ ভোট ব্যাংক তৈরি হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে আজ মঙ্গলবার দুপুরে মনীষা চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তো সব সময়ই মাঠে মানুষের দাবিদাওয়া, সমস্যা সমাধানের লড়াই-সংগ্রামে নিয়োজিত আছি। নির্বাচনকে ঘিরে আমাদের আলাদা কোনো প্রস্তুতি ও প্রচারের কিছু আছে বলে মনে হয় না। আমাদের দল সিটি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, সরকার যে ফরম্যাটে নির্বাচন করতে চায়, তাতে সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন সম্ভব—এটা দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। আর বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতিও দেশের মানুষের কোনো আস্থা নেই। তাই আমাদেরও নেই। তবে এখনো আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি, নির্বাচনে যাব কি যাব না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুদিনের মধ্যেই জানাব।’

৩ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগামী ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ সময় ১৬ মে। ১৮ মে মনোনয়নপত্র বাছাই ও ২৫ মে পর্যন্ত মনোনয়ন প্রত্যাহার করতে পারবেন প্রার্থীরা। ২৬ মে প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেবেন রিটার্নিং কর্মকর্তা। বরিশাল সিটি করপোরেশন এলাকায় ভোটকেন্দ্র ১২৩টি। মোট ভোটার ২ লাখ ৭৪ হাজার ৪০৭ জন।