দেশের সর্ববৃহৎ বিল চলনবিলে মিঠা পানির শুঁটকির চাহিদা ও উৎপাদন ক্রমেই বাড়ছে। যাঁরা নোনা পানির শুঁটকি পছন্দ করেন না, তাঁদের কাছে এই শুঁটকির জনপ্রিয়তা ব্যাপক। গত বছর এখানে প্রায় ২১ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদন করা হয়েছে। তবে এ অঞ্চলে সংরক্ষণাগার থাকলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানো সম্ভব বলে দাবি করছেন স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ীরা।
নাটোর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, চলনবিলের আয়তন ৮০০ বর্গমাইল। চার জেলায়ব্যাপী চলনবিল বিস্তৃত হলেও এর প্রাণকেন্দ্র নাটোরের সিংড়া ও গুরুদাসপুর উপজেলা। আত্রাই, বড়াল নদসহ ১৪টি নদ–নদী ও ৭১টি খাল রয়েছে বিলের নাটোর অংশে। এসব জলাশয় থেকে মাছ সংগ্রহ করে চারটি বড় চাতালসহ ৩০টি স্থানে শুঁটকি তৈরি করেন ৩১৩ জন ব্যবসায়ী। নোনা পানির শুঁটকির পাশাপাশি মিঠা পানির শুঁটকির জনপ্রিয়তা বাড়ায় চলনবিলের শুঁটকির উৎপাদনও বাড়ছে। ২০২০ সালে চলনবিলে ৩১৯ মেট্রিক টন শুঁটকি উৎপাদন করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৪১২ মেট্রিক টনে। যার বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ২১ কোটি টাকা।
চাতালের মালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি, চলনবিলের শুঁটকির জনপ্রিয়তা বাড়ার অন্যতম কারণ, এখানে রাসয়নিকের মিশ্রণ ছাড়াই শুঁটকি উৎপাদন করা হয়।
চলনবিলের যে চার স্থানে বড় পরিসরের শুঁটকি উৎপাদিত হয়, এর মধ্যে সিংড়ার নিংগইন অন্যতম। গত শুক্রবার সকালে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কসংলগ্ন এই শুঁটকি চাতালে গিয়ে দেখা যায়, ২৫ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক সেখানে কাজ করছেন। জেলেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে আনা মাছ ধুয়ে আবর্জনা পরিষ্কার করা, মাছ কাটা ও শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন শ্রমিকেরা। এর মধ্যে নারী শ্রমিকেরা বিলের তাজা টাকি মাছ কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে ধোয়ার পর লবণ মাখিয়ে মাচায় মেলে দিচ্ছেন। সকালে রোদে দেওয়া ভেজা মাছগুলোও কেউ কেউ এপিঠ-ওপিঠ উল্টে রাখছেন। রাস্তার পাশে মাচার ওপর শুঁটকির পসরা সাজিয়ে বিক্রিও করছেন কেউ কেউ। মহাসড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে অনেকেই শুঁটকি কিনছেন।
এসব চাতালের মালিক ও ব্যবসায়ীদের দাবি, চলনবিলের শুঁটকির জনপ্রিয়তা বাড়ার অন্যতম কারণ, এখানে রাসয়নিকের মিশ্রণ ছাড়াই শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। বিলের উন্মুক্ত পরিবেশে শুধু সূর্যের আলোতে মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়।
শুঁটকি চাতালের মালিক নাসির উদ্দীন বলেন, এখানকার শুঁটকি তৈরিতে লবণ ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় না। এ ছাড়া মিঠা পানির মাছের স্বাদ বেশি। তাই ক্রমেই চলনবিলের শুঁটকির চাহিদা বাড়ছে। তবে ওই অনুপাতে স্থানীয়ভাবে শুঁটকির পাইকারি ব্যবসা শক্তিশালী হয়নি।
সিংড়া মাছ বাজারের ব্যবসায়ী আবু বক্কর বলেন, চলনবিলে চেলা, টাকি, শোল, পাতাসি, চান্দা, পুঁটি, টেংরা, গজার, মাগুর, কই, চিংড়ি, রুই, কাতলাসহ বিভিন্ন প্রজাতির দেশি মাছের বিচরণ বেশি। বর্ষায় প্রচুর মাছ বংশবিস্তার করে বিলের পানিতে। বর্ষাকালে এসব মাছ খুব কমই ধরা পড়ে। তবে অক্টোবর থেকে বিলের পানি নামতে শুরু করলে মাছ ধরার পরিমাণ বহুগুণে বেড়ে যায়। এত পরিমাণ কাঁচা মাছ একসঙ্গে বাজারজাত করা সম্ভব হয় না। এ সময় ধরা পড়া মাছের একটি অংশ শুঁটকি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করেন।
তবে শুঁটকি ব্যবসায়ীদের বলছেন, এই অঞ্চলে মাছ সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। এ জন্য তাঁরা সারা বছর শুঁটকি উৎপাদনের সুযোগ পাচ্ছেন না। শুঁটকি ব্যবসায়ী জমির উদ্দীন বলেন, ‘আমাদের শুঁটকির মান ভালো। বিক্রিও ভালো। কিন্তু সারা বছর আমরা শুঁটকি উৎপাদন ও বিক্রি করতে পারি না। কারণ, এখানে মাছ সংরক্ষণ করে রাখার ব্যবস্থা নাই।’
শুঁটকি ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম বলেন, যদি মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা থাকত, তাহলে শুঁটকি উৎপাদনে এখানে বিপ্লব ঘটত। বর্ষাকালে পানির দামে যেসব মাছ বিক্রি হয়, সেগুলো শীতকাল পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারলে জেলে ও ব্যবসায়ী—উভয়েই লাভবান হতেন।
গুরুদাসপুরের শুঁটকি উৎপাদন করেন মজিবর রহমান। তিনি বলেন, মিঠা পানির মাছের বাজারমূল্য বেশি। তাই শুঁটকির দাম তুলনামূলক কিছুটা বেশি। যেমন আকারভেদে প্রতি কেজি শোল ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩০০ টাকা, পুঁটি ৩০০, টাকি ৩৫০, চেলা ৬০০, পাতাসি ৮০০, কাঁচকি ৭০০, বোয়াল ৮০০ থেকে ১ হাজার, চাপিলা ৪০০, মলা ৫০০ ও বাইন ১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, বর্ষা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় চলনবিল এবার বেশি সময় পানি ধরে রেখেছে। এতে গত বছরগুলোর তুলনায় বিলে মাছের পরিমাণ ও আকার দুটোই বেড়েছে। জেলে ও ব্যবসায়ীরা সংরক্ষণাগারের দাবি জানিয়েছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ইতিমধ্যেই জানানো হয়েছে।