জনি বিশ্বাস (৩২) ও নিপা রানী মল্লিক (২৬) দম্পতি যে সাততলা ভবনে সাবলেট হিসেবে ভাড়া থাকতেন, সেই ভবনের অন্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা তাঁদেরকে শান্ত, ভদ্র ও সুখী দম্পতি হিসেবে জানতেন। এই দম্পতির মধ্যে বিরোধ হয়েছে, এমন কিছু কখনো তাঁদের চোখে পড়েনি। সংসারে অর্থের টানাটানি ছিল। কিন্তু কখনোই ফ্ল্যাটের কারও কাছে টাকা বা অন্য কোনো প্রয়োজনীয় জিনিস ধার চাননি। আজ বুধবার ওই ভবনের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য জানা গেছে।
কিশোরগঞ্জের ভৈরব শহরের রানীবাজার এলাকার শাহজাহান মিয়ার ভবন এটি। তিন মাস আগে এই ভবনের ছয়তলার ছাদে চিলেকোঠার দুই কক্ষের ফ্ল্যাটের একটি কক্ষ সাবলেট হিসেবে ভাড়া নেন জনি-নিপা দম্পতি। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রতিবেশীরা দরজা ভেঙে ওই ফ্ল্যাটে ঢুকে একই কক্ষে পরিবারের চারজনের লাশ দেখতে পান। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে তাঁদের লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় এলাকায় চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে।
নিহত চারজনের মধ্যে গৃহকর্তা জনি বিশ্বাসের (৩২) লাশ ঝুলছিল বৈদ্যুতিক ফ্যানে। তাঁর স্ত্রী নিপা রানী মল্লিকের (২৬) গলা কাটা ছিল। তাঁদের দুই শিশুসন্তান ছেলে ধ্রুব বিশ্বাস (৭) ও মেয়ে কথা বিশ্বাসের (৪) লাশ পড়ে ছিল খাটে। নিপা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। পুলিশের ধারণা, স্ত্রী ও সন্তানদের হত্যার পর জনি নিজে ‘আত্মহত্যা’ করেছেন।
এ ঘটনায় আজ সকালে ভৈরব থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলাটি করেছেন জনির মা শিখা রানী বিশ্বাস। পুলিশ এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন কাউকে আটক করতে পারেনি। তবে জনির সঙ্গে একই ফ্ল্যাটে সাবলেট নিয়ে বসবাস করা কার্তিক বর্মণ ও সৃষ্টি রানী বর্মণ দম্পতিকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। চার মরদেহ উদ্ধারের পর থেকে কার্তিক-সৃষ্টি দম্পতি ফ্ল্যাট ছেড়ে অন্যত্র অবস্থান করছেন। কার্তিক ভৈরবের একটি ডালের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন।
সাততলা ভবনটির ছয়তলায় থাকেন পপি বেগম। জনি-নিপা দম্পতির সঙ্গে তাঁর দেখা ও কথা হতো। পপি বলেন, ‘সবকিছু মিলিয়ে মনে হয়েছে, ওই দম্পতির সংসারে অর্থকষ্ট আছে। কিন্তু তাঁদের অসুখী মনে হতো না। আর্থিক বা অন্য কোনো প্রয়োজনে আমাদের কারও কাছে কোনো দিন সাহায্য চাননি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জনি বিশ্বাসের বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের আনারাবাদ গ্রামে। বাবার নাম গৌরাঙ্গ চন্দ্র বিশ্বাস। জনি আট বছর ধরে স্ত্রীকে নিয়ে ভৈরবে বসবাস করে আসছিলেন। স্বজনেরা জানান, ভৈরব বাজারের বাগানবাড়ি এলাকায় মিজান মিয়ার ওয়ার্কশপে হেডমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন জনি। ৯ বছর আগে গাজীপুরের নির্মল মল্লিকের মেয়ে নিপা রানী মল্লিককে বিয়ে করেন তিনি। জনি-নিপা দম্পতির দুই সন্তান ধ্রুব ও কথা। ধ্রুব স্থানীয় একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। নিপা আবারও অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন।
আজ সকালে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটিতে সুনসান নীরবতা। বেশির ভাগ ঘরের দরজায় তালা ঝুলছে। জনির সঙ্গে সাবলেট থাকা কার্তিক-সৃষ্টি দম্পতিও নেই।
জনি-নিপার স্বজনেরা জানান, গত রোববার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে জনি গ্রামের বাড়িতে যান। পরদিন সোমবার ফিরে আসেন। জনি সকাল ১০টার মধ্যে ওয়ার্কশপে কাজে যেতেন। একই ওয়ার্কশপে কাজ করেন জনির আপন মাসতুতো (খালাতো) ভাই ঝোটন প্রামাণিক। গতকাল সকাল ১০টা পেরিয়ে গেলেও কাজে না আসায় ওয়ার্কশপের মালিক মিজান মিয়ার নির্দেশে ঝোটন যান জনিকে ডেকে আনতে। অনেক ডাকাডাকির পরও দরজা না খোলায় ফিরে আসেন। আবার যান বেলা আড়াইটায়। তখনো দরজা না খোলায় ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে যান। পরে দরজার চৌকাঠের একটি ছিদ্র দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে দেখতে পান জনির মরদেহ ঝুলছে। এ সময় পাশের কক্ষেই ছিলেন সাবলেট প্রতিবেশী সৃষ্টি বর্মণ।
ঝোটন প্রামাণিক বলেন, ‘আমরা দুবার ডাকলাম। কারও কোনো সাড়া পেলাম না। সাবলেটে থাকা পরিবারের সদস্যরাও আমাদের ডাকে সাড়া দেননি। শেষে ধাক্কা দিয়ে ঘরের প্রধান দরজা খুলে ভেতরে যাওয়ার পর সৃষ্টি রানীর দেখা পাই। বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছি।’
অনেক চেষ্টার পর বিকেলে সাক্ষাৎ পাওয়া যায় কার্তিক ও সৃষ্টি দম্পতির। ঝোটন প্রামাণিক বারবার ডাকার পরও সাড়া না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে সৃষ্টি রানী বলেন, ‘সোমবার জনি ও নিপা গ্রামের বাড়ি থেকে বাসায় আসেন সন্ধ্যার দিকে। তখন আমরা বাসায় ছিলাম। কিছুক্ষণ পর একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমরা চলে যাই। ফিরে আসি ভোরে। এসে দেখি, জনি-নিপার রুমের দরজা বন্ধ। আমরা ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে আমার স্বামী কাজে চলে যায়। তখনো দরজা বন্ধ পাই। আমিও সবজি কিনতে বাইরে যাই। বেলা ১১টার পর ঘরে এসে রান্নাবান্না করি এবং দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ি। কখন কীভাবে এ ঘটনা ঘটল, আমরা টের পাইনি।’
সৃষ্টি রানী জানান, তাঁরা দুই পরিবার ঘরে ঢোকে এক দরজা ব্যবহার করে। ভেতরে গিয়ে পৃথক কক্ষে থাকেন। কিছুদিন ধরে মূল দরজার ছিটকিনি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় খোলা রেখেই থাকতে হচ্ছিল। গতকাল ভোরে ঘরে এসে দেখতে পান, জনি-নিপার ঘরের দরজা ভেতর থেকে আটকানো।
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরে গতকাল বিকেল ৫টা ২০ মিনিটে প্রথমে নিপা ঘরে ঢোকেন। ১৮ মিনিট পর ৫টা ৩৮ মিনিটে আসেন জনি। সকালে কার্তিক ও সৃষ্টি বের হয়ে যাওয়ার পর বেলা ১১টা ২৪ মিনিটে ঘরে ফিরে আসেন সৃষ্টি। বেলা ১টা ৩৭ মিনিটে ঘরে আসেন কার্তিক।
ভৈরব বাজারের বিপুল ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে চার বছর কাজ করেছেন জনি। দেড় বছর আগে এই ওয়ার্কশপ ছেড়ে চলে যান। জনি সম্পর্কে মালিক বিপুল বর্মণ বলেন, ‘আমি জনিকে ১৭ হাজার টাকা বেতন দিতাম। অর্থের বিশেষ প্রয়োজন আছে, এমন কোনো বিষয় নিয়ে আমার সঙ্গে কখনো কথা বলেনি। স্ত্রীকে নিয়ে ঝামেলায় আছে, এই রকম কথাও তার মুখ থেকে বের হয়নি।’
জনির ছোট ভাই পলাশ বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের মনে হচ্ছে, ঘটনাটির পেছনে অন্য ঘটনা থাকতে পারে। এ জন্যই হত্যা মামলা করেছি।’
এদিকে এক পরিবারের চারজনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কিশোরগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী। এ ছাড়া র্যাব, ক্রাইম সিন ও পিবিআইয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
মামলাটি তদন্ত করছেন ভৈরব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) দায়িত্বে থাকা পরিদর্শক (তদন্ত) মো. শাহিন। তিনি বলেন, ‘হত্যা মামলা হয়েছে। আমরা নানা দিক মাথায় রেখে তদন্ত করছি।’
পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের তদন্তে কিছু মানুষের কাছ থেকে জানতে পেরেছি, জনি নেশা করতেন। তবে ঘটনার সঙ্গে নেশার সম্পর্ক রয়েছে কি না, নিশ্চিত নই।’