রাজশাহী নগরের তালাইমারী-কাটাখালী সড়কের কাজলা এলাকায় সড়ক বিভাজক ২ ফুটের কম রাখা হয়েছে। রাস্তাও সরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি তোলা
রাজশাহী নগরের তালাইমারী-কাটাখালী সড়কের কাজলা এলাকায় সড়ক বিভাজক ২ ফুটের কম রাখা হয়েছে। রাস্তাও সরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি তোলা

রাজশাহী সিটি করপোরেশন

পরিকল্পনার সঙ্গে মিল নেই ৯৪ কোটি টাকার সড়কের

প্রায় ৯৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ছয় লেনের ‘বিশ্বমানের’ একটি সড়ক করতে চেয়েছিল রাজশাহী সিটি করপোরেশন। যেখানে দুই মিটার সড়ক বিভাজক থাকবে, অযান্ত্রিক যানবাহন (সাইকেল, রিকশা) চলাচলের লেন থাকবে; হবে চওড়া ফুটপাত ও নালা। সেই অনুযায়ী কাজও শুরু হয়েছিল; কিন্তু কাজের শেষের দিকে এসে দেখা যাচ্ছে, সড়কটি কোথাও সরু হয়ে গেছে, কোথাও সরু হয়েছে নালা ও ফুটপাত। সড়ক বিভাজকও চাপানো হয়েছে কোনো কোনো জায়গায়।

রাজশাহী নগরের তালাইমারী মোড় থেকে কাটাখালী বাজার পর্যন্ত সড়কটি নগরের প্রধান প্রবেশদ্বার। ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের এই ৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার অংশ ছয় লেনে উন্নীত করা হচ্ছে। তবে জমি অধিগ্রহণ করতে না পারায় পরিকল্পনামতো সড়ক প্রশস্ত হচ্ছে না। এতে যানজটের ভোগান্তি কমবে না বলে মনে করছেন চালক ও স্থানীয় বাসিন্দারা। বাড়বে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও।

সরকারের অর্থায়নে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এই সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ৯৩ কোটি ৪৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয়ে কাজটি পেয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার হোসেন লিমিটেড। ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর শুরু হওয়া কাজটি আগামী সেপ্টেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা।

সড়ক নির্মাণকাজের উদ্বোধনের সময় সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয়েছিল, সড়কটি নির্মিত হলে এটি হবে বিশ্বমানের। সিটি মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন বলেছিলেন, ‘আজ অত্যন্ত আনন্দের দিন। কারণ তালাইমারী মোড় থেকে কাটাখালী বাজার পর্যন্ত অযান্ত্রিক যানবাহন লেনসহ ছয় লেন সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। এমন সড়ক রাজশাহীতে এ–ই প্রথম।’

ওই সময় সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়, ৪ দশমিক ১০ কিলোমিটার সড়কের মাঝখানে থাকবে ২ মিটারের সড়ক বিভাজক। সড়ক বিভাজকের দুই পাশে থাকবে ১০ দশমিক ৫ মিটারের সড়ক। সড়কের উভয় পাশে থাকবে ৩ মিটার অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের লেন এবং ৩ মিটার করে ফুটপাত ও ড্রেন। সড়কটির সৌন্দর্য বাড়াতে বৃক্ষরোপণও করা হবে।

নগরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বিনোদপুর ফটক থেকে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) সামনে হয়ে তালাইমারী পর্যন্ত সড়কে মাঝেমধ্যেই যানজট তৈরি হতো। সেই ভোাগান্তি লাঘবে রাস্তা প্রশস্তের উদ্যোগ নেয় সিটি করপোরেশন।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, রুয়েটের সামনে এখনো ড্রেন ও সড়কের কাজ শেষ হয়নি। সেখানে সড়ক বিভাজকও তৈরি হয়নি। বিনোদপুর অংশ থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পর্যন্ত সড়কের প্রস্থ কিছুটা কমেছে। এর মধ্যে প্রধান ফটক থেকে কাজলা পর্যন্ত প্রায় আধা কিলোমিটারের সড়কের অংশ একেবারে চেপে গেছে। এই অংশে উত্তর পাশের ফুটপাতও সরু হয়েছে। কাজলা থেকে অকট্রয় মোড় পর্যন্ত সড়ক বিভাজক তিন ফুটও রাখা হয়নি। উত্তর পাশে ফুটপাত ও নালা দুই ফুটের বেশি রাখা হয়নি। তবে সড়ক বিভাজক ও ফুটপাত কমিয়েও সড়ক প্রশস্ত করা যায়নি। বিনোদপুর থেকে কাটাখালী পৌরসভা সীমান্ত পর্যন্তও রাস্তা অনেক জায়গা চেপে গেছে। আবাসিক এলাকা বিহাসের পাশেও রাস্তা চেপে গেছে। ধান ও গম গবেষণার পূর্ব পাশ থেকে কাটাখালী পৌরসভা সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা চেপে গেছে।

রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই রাস্তার বিনোদপুরে জায়গা বেশি; কিন্তু কাজলার দিকে কম। রাস্তা হঠাৎ করে চেপে গেলে গাড়িচালকদের অসুবিধায় পড়তে হয়। অনেক সময় দুর্ঘটনারও আশঙ্কা থাকে।

নগরের মাসকাটাদীঘি এলাকায় কথা হয় স্থানীয় মো. আনোয়ারুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখানে সড়কের প্রায় ৩৫০ মিটার একেবারে চেপে গেছে। প্রায় ৯৪ কোটি টাকা খরচ করে যে রাস্তা করা হচ্ছে, এটি ভবিষ্যতে আবার করতে হবে।

এই সড়ক দিয়ে নিয়মিত অটোরিকশা চালান আবদুল মাজেদ। তিনি বলেন, এই রাস্তার কোথাও বেশি জায়গা, আবার কোথাও একেবারে চাপা। তালাইমারীর এখানে তো একটি বাস দাঁড়ালে আরেকটি গাড়ি যেতেই পারে না।

সমন্বিত নগর অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্বে আছেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই রাস্তার পাশের জমিগুলো ব্যক্তিগত, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের। তাঁরা ভূমি অধিগ্রহণের আবেদন করেছিলেন; কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের যে অবস্থা, তাতে ভূমি অধিগ্রহণ হবে না। এ কারণে জায়গার অভাবে রাস্তার পুরো অংশ একরকম করতে পারেননি। ১০-১২ বছর পরে যদি অধিগ্রহণ করতে পারে, তখন হয়তো পুরোপুরি রাস্তা চওড়া করা যাবে। এভাবে সড়ক নির্মাণ করা হলেও ব্যয় একই থাকছে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার হোসেন লিমিটেডের সুপারভাইজার কুমারেশ দাস বলেন, আসলে সিটি করপোরেশনের সিদ্ধান্তের কোনো ঠিক নেই। তারা জমি অধিগ্রহণ না করেই রাস্তার কাজে এসেছে। এমনও হয়েছে—ড্রেন (নালা) তৈরি করে সেই ড্রেন ভেঙে আবার করতে হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাত খান প্রথম আলোকে বলেন, কেন জমি অধিগ্রহণ না করে এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে? এটি অর্থের বিশাল অপচয়। এই রাস্তা একসময় ভেঙে আবার নতুন করে করতে হবে। যে প্রতিষ্ঠানই এর সঙ্গে জড়িত, তারা অর্থের অপচয় করেছে। এটি এখনই বন্ধ করে নকশা অনুযায়ী করা উচিত।