খেতের মধ্য দিয়ে প্রায় বুকসমান পানি ভেঙে মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কে উঠে আসছিলেন কয়েকজন। মনু নদ প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বাঁধের ওপর দিয়ে সড়কে আসার সুযোগ নেই। পানি অনেকটা কমে আসছে, কিন্তু ভাঙা অংশ দিয়ে পার হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। মনু নদ প্রকল্পের বাঁধ ভেঙে ওই এলাকায় বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।
আজ শনিবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের কদমহাটা এলাকাতে তাঁদের সঙ্গে দেখা। তাঁরা বন্যায় ডুবে যাওয়া নিজেদের ঘরদোর দেখে ফিরছিলেন।
এ দলেরই একজন কদমহাটা গ্রামের মনোয়ারা বেগম। তিনি বলেন, ‘ঘরর অবস্থা খুবই খারাপ। বেড়া ভাঙি গেছে। কিছু মাল বাইর অইয়া গেছেগি (জিনিস বের হয়ে গেছে)। ঘর ঠিক করা লাগব। কিন্তু কমলাখান (কেমন করে) যে ঠিক করতাম। বাঁশ-ঘাস কিচ্ছু নাই। ভাত খাইতাম, না ঘর ঠিক করতাম, চিন্তা লাগের।’
মনোয়ারা বেগম জানান, গত বুধবার দুপুরে ঘরে পানি ঢুকেছে। তাঁর কাঁচা ঘর। দেখতে দেখতে ঘরে কোমরসমান পানি হয়ে গেছে। তাঁরা কোনো রকম ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর কদমহাটা স্কুলে গিয়ে উঠেছেন। শুধু তিনি নয়, তাঁদের পাড়া-প্রতিবেশীর অনেকেই স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন। এর পর থেকে আশ্রয়কেন্দ্রেই আছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে যেমন-তেমন করে হোক, চলে যাচ্ছে। অনেকে শুকনা খাবারসহ কিছু না কিছু দিচ্ছেন। কিন্তু ঘরের অবস্থা দেখে মনটা ভেঙে গেছে। কী করে ঘরে ফিরবেন, এ নিয়ে চিন্তায় আছেন।
তাঁর প্রতিবেশী সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক ফজলু মিয়ার চিন্তাও কম নয়। ফজলু মিয়া বলেন, ‘কাঁথা-বালিশ আর হুরুত্বা লইয়া (বাচ্চা নিয়ে) কোনো রকম বাইর অইছি (বের হয়েছি)। আইজ (শনিবার) গিয়া ঘর দেখছি। ঘরও অখনো (এখনো) ঠাঁই নাই (অনেক পানি)। ঘরর নিচ ফুক্কা (ছিদ্রময়)। ভিটারে একবারে সুড়ঙ্গ (নালার মতো) করি লাইছে (করে ফেলছে)। বেড়াও পানিয়ে নিয়া গেছে। ঘরও যাওয়ার কোনো রাস্তা নাই। চাইর দিন ধরি খিচুড়ি-টিচুড়ি খাইয়া স্কুলও আছি।’
ফজলু আরও বলেন, তাঁদের প্রায় ১২ সদস্যের পরিবার। ঘরের জায়গাটাও নিজের নয়। পরিচিত একজন ঘরটা বানিয়ে দিয়েছিলেন। কবে-কীভাবে ঘর ঠিক করবেন, চিন্তা করে কোনো কূল পাচ্ছেন না। দুই-চার দিনের মধ্যে পানি নেমে গেলেও এই ঘরে ১৫-২০ দিনের আগে ফেরার সুযোগ দেখছেন না।
ফজলু আর মনোয়ারা বলেন, তাঁদের পাশের আরও চারটি ঘর কাত হয়ে আছে। পানি নামলে পড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি এ রকম ১০-১৫টি ঘর আছে। সব কটিরই একই অবস্থা। ভাঙনের মুখে থাকা রিপন মিয়া ও আছমা বেগমের ঘর পানির তোড়ে ভেসে গেছে। ভিটার মাটিটুকুও নেই। ভেসে যাওয়া একটি ঘরের টিনের চাল ভাঙনের ভাটিতে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বুধবার রাতে রাজনগর উপজেলার শ্বাসমহল এলাকায় মনু সেকেন্ডারি বাঁধ (নদ-সংলগ্ন বাঁধ) ভেঙে সেকেন্ডারি বাঁধ ও মনু নদ প্রকল্প বাঁধের মধ্যবর্তী গ্রামে পানি প্রবেশ করে। রাতের মধ্যে প্রায় সব ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যায়। মধ্যবর্তী গ্রামের লোকজনের অনেকে বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন কদমহাটা উচ্চবিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অনেকে বাঁধের ওপর কোনোমতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার কদমহাটা এলাকায় পানি উপচে মনু নদ প্রকল্পের বাঁধের একাধিক স্থান ভেঙে যায়। কিন্তু এখন পানি ধীরে ধীরে নামছে। কয়েক দিনের মধ্যে ঘরবাড়ি থেকেও পানি নেমে যাবে। চিন্তা শুধু যাঁদের ঘর ভেঙেছে, তাঁদের নয়। যাঁদের ঘর ভাঙেনি, তাঁরাও ১০-১৫ দিনের আগে সেখানে উঠতে পারবেন কি না, সন্দেহ আছে। কারণ, পানি-কাদায় সেখানে আর থাকার অবস্থা নেই।
কদমহাটা উচ্চবিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া ছয়ফুল বেগম তাঁর মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলেকে নিয়ে ঘরের অবস্থা দেখতে বেরিয়েছেন। মৌলভীবাজার-কুলাউড়া সড়কে তাঁর সঙ্গে দেখা। তিনি বলেন, ‘বুধবার রাইত (রাতে) পানি আইছে (এসেছে)। বৃহস্পতিবারে ঘরের অর্ধাঅর্ধি (আধাআধি) পানি। এরপর ঘরও থাকতাম পারছি না। পানির লাগি অখনো (এখনো) ঘরর অবস্থা গিয়া দেখতাম পারছি না। চালরসমান (ঘরের চাল) পানি। দুই দিন আধাপথও (অর্ধেক পথে) গিয়া ফিরত আইছি।’
ছয়ফুল এখন অনেকটা দূর ঘুরে ঘরে বাড়ির কাছে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। আশ্রয়কেন্দ্রে অনেকে চিড়া, আখনি দিচ্ছেন। তাতে দিন চলছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘরে তো ফিরতে হবে তাঁদের।
মনু নদ প্রকল্পের বাঁধে দেখা পেশায় রাজমিস্ত্রি মালিকোনা গ্রামের সাহেল মিয়ার সঙ্গে। তিনি একটি ঠেলা গাড়ি নিয়ে কিছু নিতে এসেছেন। সাহেল মিয়া বলেন, ‘বাড়িতে দুই মানুষসমান পানি উঠছিল। এখনো হাঁটুসমান পানি। সব ঘরেই পানি। প্রায় ঘর ভাঙি গেছে। মনু ডাইকে (সেকেন্ডারি বাঁধে) অনেক মানুষ আছে। সবার ঘরেই পানি। অনেকে এসে কিছু চাল, চিড়া, মুড়ি, ওষুধ দিছে, তা দিয়েই চলছে তাঁদের।’
প্রেমনগর গ্রামের খোদেজা বেগম বুধবার থেকে বাঁধে আছেন। আজ বেরিয়েছেন বাবার বাড়ি শ্রীমঙ্গল যাওয়ার জন্য। তিনি বলেন, ‘ঘর থাকি কোনো রকম জান লইয়া বাইর অইছি (প্রাণ নিয়ে বেরিয়েছি)। ঘরও এখনো পানি। ঘরে ঢুকতাম পাররাম (পারছি) না। হাঁটু পর্যন্ত কাদায় গাড়ে (কাদায় ডুবে যায়। এখন দেখি কিছু খানি-খোরাক (খাদ্যপণ্য) লইয়া আইতামনি পারি (আসতে পারি কি না)।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) মৌলভীবাজার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আজ দুপুর ১২টায় মনু নদের পানি রেলওয়ে ব্রিজের কাছে বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে এবং চাঁদনীঘাটে ৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কুশিয়ারা নদী শেরপুরে ৯ সেন্টিমিটার এবং জুড়ী নদী ভবানীপুরে ১৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অপর দিকে ধলাই নদের পানি রেলওয়ে ব্রিজের কাছে বিপৎসীমার ২১২ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।