১৭ বছর আগে টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে কোমরের নিচের অংশ অচল হয়ে যায় নুরুল ইসলামের। হাঁটাচলার শক্তি হারিয়ে ফেলেন। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। তবে তিনি ভেঙে পড়েননি। শারীরিক বাধা পেরিয়ে তিনি বাড়ির পাশে চায়ের দোকান চালাচ্ছেন। এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জাল বোনেন। তাঁর আয়েই চলছে সংসার।
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার আন্দুয়া গ্রামে সড়কের পাশে নুরুল ইসলামের (৬০) চায়ের দোকান। তাঁর স্ত্রী গৃহিণী। তাঁদের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে; শ্বশুরবাড়িতে থাকেন। বড় ছেলে ঢাকায় ওষুধের দোকানে কাজ করেন। ছোট ছেলে উপজেলার সুবিদখালী সরকারি কলেজে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।
সম্প্রতি আন্দুয়া গ্রামে ওই দোকানে কথা হয় নুরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি জাল বুনছিলেন। খাটের ওপর বসে আছেন—পা দুটি সামনে রাখা। হঠাৎ দেখে বোঝার উপায় নেই তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। হাতের কাছেই গ্যাসের চুলায় চায়ের কেটলি বসানো। মাঝেমধ্যে ক্রেতাদের চা তৈরি করে দিচ্ছেন। হাতের নাগালের বাইরের জিনিসপত্র আনার জন্য ব্যবহার করছেন একটি কাঠি।
দোকানের কাজ করতে করতে নুরুল ইসলাম তাঁর সংগ্রামী জীবনের গল্প শোনান। চাষাবাদের জন্য তাঁর কোনো জমি নেই। অসুস্থ হওয়ার আগে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সামান্য বেতনে চাকরি করতেন। সেখানে ২০০৭ সালে টাইফয়েডে আক্রান্ত হন। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার পরও তিনি পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি। তাঁর দুই পা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কর্মহীন হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। অভাবের সংসারে কিছু একটা করতে হবে। তাই এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বাড়ির পাশে চায়ের দোকান দেন নুরুল ইসলাম। দোকানে যখন ক্রেতা থাকে না, তখন মাছ ধরার জাল বোনেন। বসতঘর কাছাকাছি থাকলেও তিনি বাড়িতে যেতে পারেন না। তাঁর খাওয়াদাওয়া, ঘুম—সবই চায়ের দোকানে।
নুরুল ইসলাম বলেন, ‘অজপাড়াগাঁয়ে দোকান। যখন ক্রেতার সংখ্যা কম থাকে, তখন সুতা, লোহা কিনে মাছ ধরার ঝাঁকি জাল (ছোট ফাঁদের জাল) তৈরি করি। প্রতিটি জাল বিক্রি করে এক থেকে দেড় হাজার টাকা লাভ হয়। একটি জাল তৈরি করতে এক থেকে দুই মাস লেগে যায়।’
নুরুল ইসলাম প্রতিবন্ধী ভাতা পান। তবে সংসারের খরচের তুলনায় তা খুবই কম। তিনি বলেন, ‘শুয়ে শুয়ে যা আয় করি, তা দিয়ে কোনো রকম আমার খরচ চলে যায়। দোকানে মালামাল বেশি নেই; টাকার অভাবে কিনতে পারি না। মালামাল থাকলে মোটামুটি বেচাকেনা হয়।
যা আয় করি, তা দিয়ে কোনো রকম আমার খরচ চলে যায়। দোকানে মালামাল বেশি নেই; টাকার অভাবে কিনতে পারি না। মালামাল থাকলে মোটামুটি বেচাকেনা হয়।নুরুল ইসলাম, পক্ষাঘাতগ্রস্ত দোকানি
নুরুল ইসলামের স্ত্রী শিল্পী বেগম বলেন, ‘প্রতিবন্ধী ভাতার টাকায় শুধু কয়েক দিনের ওষুধ কেনা যায়। টাকার অভাবে দোকানে তেমন মালামাল তুলে দিতে পারি না। ছোট ছেলে কলেজে পড়ে; বই–খাতা কিনে দিতে পারি না। খুব কষ্টে দিন কাটছে আমাদের।’
আন্দুয়া গ্রামের বাসিন্দা স্থানীয় একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক এইচ এম নুরুল হক বলেন, নুরুল ইসলাম পক্ষাঘাতগ্রস্ত হলেও কার বোঝা নন। এ অবস্থায় অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি করেন। তবে তিনি দোকান চালাচ্ছেন। সংগ্রাম করে সংসারের বোঝা টেনে নিয়ে চলছেন।