পুলিশ কর্মকর্তার বাড়ির জন্য সরকারি খরচে নির্মাণ করা হয়েছে কালভার্ট সেতু। এই সেতু দিয়ে অন্য কেউ চলাচল করেন না
পুলিশ কর্মকর্তার বাড়ির জন্য সরকারি খরচে নির্মাণ করা হয়েছে কালভার্ট সেতু। এই সেতু দিয়ে অন্য কেউ চলাচল করেন না

মাদারীপুরে পুলিশ কর্মকর্তার বাড়ির জন্য সরকারি খরচে সেতু নির্মাণ

ফসলি জমির ওপর মাটি ফেলে নির্মাণ হচ্ছে একটি ডুপ্লেক্স ভবন। ওই বাড়ির আশপাশে কোনো বসতি নেই। পাশে একটি মরা খাল। এই খালের অপর পাশে বাড়িঘর রয়েছে। শুধু নির্মাণাধীন ওই বাড়িতে প্রবেশ করতেই সরকারি অর্থায়নে নতুন একটি কালভার্ট সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। ওই বাড়ি নির্মাণ করছেন শরীয়তপুরের জাজিরা থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান মোল্লা।

মাদারীপুর সদর উপজেলার ঘটমাঝি ইউনিয়নের ইটেরপুল থেকে পাথুরিয়ারপাড় সড়কের পাশে ছৈয়না গ্রামের বরিশাল খালের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে এই কালভার্ট। অভিযোগ রয়েছে, মোস্তাফিজুর রহমান মোল্লা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সেতুটি নির্মাণ করেছেন। সেতুটির নাম দেওয়া হয়েছে কামাল মোল্লার বাড়ির নিকট কালভার্ট সেতু।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কামাল মোল্লা পুলিশ পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান মোল্লার ছোট ভাই। বর্তমানে মোস্তাফিজুর রহমান রাজধানীর উত্তরা জোনে হাইওয়ে থানায় পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। জাজিরা থানার ওসি থাকাকালে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে বিশেষ তদবির করে নিজের বাড়ির জন্য এই সেতু বরাদ্দ করিয়ে আনেন।

আরসিসি কালভার্ট সেতুতে উঠতেই নামফলকে ৩ কোটি ২৩ লাখ ৮৭ হাজার ৯৬ টাকায় আবরার এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে কাজটি বাস্তবায়ন হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এত টাকা মূল্যে সেতু নির্মাণ নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। পরে মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রকৌশলী কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালভার্ট সেতুটির চুক্তির মূল্য ৩২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা হলেও নামফলকের চুক্তির মূল্য ভুল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এডিপির অর্থায়নে সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য শাজাহান খানের ভাই ওবায়দুর রহমান খান ও উপজেলা প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেনের স্বাক্ষরিত কাগজে এই সেতুর কাজটি বাস্তবায়ন হয়।

কালভার্ট সেতুটির চুক্তির মূল্য ৩২ লাখ ৩৮ হাজার টাকা বলে জানিয়েছে মাদারীপুর সদর উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয়

সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমান খান একটি হত্যা মামলার আসামি হওয়ায় তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। এ সম্পর্কে এলজিইডির সদর উপজেলা প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই খালের ওপর আরও কয়েকটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এই সেতুগুলো উপজেলা চেয়ারম্যানের বাজেট থেকে পাস করা। যেখানে চেয়ারম্যান সেতু নির্মাণ করবেন বলে মনে করেছেন, সেখানেই নির্মাণ করেছেন। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।’

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, আনু মোল্লার ছেলে পুলিশে চাকরির সুবাদেই তাঁর বাড়ির সামনেই সেতুটি নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। কালভার্ট সেতুটি দিয়ে শুধু পুলিশের পরিবারের লোকজনই চলাচল করতে পারবেন, অন্য বাড়ি কিংবা অন্য এলাকার কেউ এই সেতুর সুবিধা পাবেন না। বিষয়টি খুবই আশ্চর্যজনক।

ছৈয়না গ্রামের বাসিন্দা লোকমান ব্যাপারী বলেন, অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, একটি পরিবারের জন্য সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। আশপাশে আর কোনো পরিবারও নেই। ক্ষমতা পাওয়া গেলে সবই যেন সম্ভব। এই সেতুই তার প্রমাণ।

নয়ন মিয়া নামের আরেক প্রতিবেশী বলেন, ‘সেতুটি ক্ষমতার অপব্যবহার আর চেয়ারম্যানের সঙ্গে লিয়াজোঁ করেই করেছে। একটি বাড়ির জন্য একটি ব্রিজ কখনোই প্রয়োজন হয় না। ক্ষমতা আছে, এ জন্যই করা সম্ভব হয়েছে। বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা দরকার। এভাবে সরকারের টাকা অপচয় করার কোনো অর্থই হয় না। যারা এখানে প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও সরকারি অর্থে সেতু করেছে, তাদের বিচার ও জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি করছি।’

পুলিশ কর্মকর্তার নির্মাণাধীন বাড়ি

সেতু ও বাড়ি নির্মাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাজিরা থানার সাবেক ওসি মোস্তাফিজুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘কালভার্ট সেতু নির্মাণের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। যৌথ পরিবার হওয়ায় বাড়িটি নির্মাণ করেছেন আমার বাবা। এখানে আমার কোনো অর্থ নেই। বাবার বাড়ির সামনে কালভার্ট সেতুটি নির্মাণ নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তাতে আমি নিজেও বিব্রত। অন্য কোথাও সেতুটি নির্মাণ না করে আমার বাবার বাড়ির সামনে সেতু নির্মাণ করায় ঠিকাদারদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ঠিকাদারও বিষয়টি এড়িয়ে যায়। এলাকার মানুষ না জেনেই আমার ওপর এমন মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। আমি কালভার্ট নির্মাণের ব্যাপারে কিছুই জানি না।’

সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য আঞ্জুমান জুলিয়া বলেন, এই খালের ওপর অনেকেই ব্যক্তিগত অর্থায়নে কালভার্ট করে নিয়েছেন। কিন্তু ওই পুলিশ কর্মকর্তা শুধু তাঁর বাড়িতে যাতায়াতের জন্য সরকারি অর্থায়নে সেতু করেছেন। এই সেতু গণমানুষের কোনো কাজে লাগবে না। এখানে কেন সেতু নির্মাণ করা হলো, কারা এখানে বরাদ্দ দিল, এসব কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহির পাশাপাশি আইনের আওতায় আনতে হবে। নয়তো এসব অপচয় থামানো যাবে না।

একটি বাড়ির জন্য একটি সেতু নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াদিয়া শাবাব বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে জবাব দিতে পারবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর। এ ছাড়া সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা প্রকৌশলী কীভাবে এমন প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, সেটি আমার বোধগম্য নয়। আমি এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’