মালয়েশিয়া থেকে ফেরার এক দিন পর স্নাতকপড়ুয়া ছোট বোনকে সঙ্গে নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন সাইফুল ইসলাম (৩২)। ৫ আগস্ট সরকার পতনের দিন রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। পরদিন গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।
নিহত সাইফুল ইসলামের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নের বাড়ইকান্দি গ্রামে। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তাঁকে হারিয়ে পরিবার দিশাহারা।
এলাকাবাসী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সাইফুল দ্বিতীয়। ১৭ বছর আগে বাবা সিকান্দার আলীর মৃত্যুর পর সাইফুল পরিবারের হাল ধরেন। কিশোর বয়সে কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে বছরখানেক আগে মালয়েশিয়ায় যান। তাঁর আয়েই সংসারের খরচের পাশাপাশি বোন লিমা আক্তারের লেখাপড়া চলত। লিমা ময়মনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী।
স্বজনেরা জানান, সরকার পতনের দুই দিন আগে ৩ আগস্ট রাতে দেশে ফেরেন সাইফুল। রাত সাড়ে ১০টায় বিমানবন্দরে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান বোন লিমা আক্তার। ওই দিন রাতে উত্তরায় এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। পরদিন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দুই ভাই-বোন যোগ দেন। ৫ আগস্ট সকালে আবার বোনকে নিয়ে আন্দোলনে অংশ নেন; কিন্তু বিকেলে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে সাইফুলের বুকে একটি গুলি লাগে। সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন। পরে বোন লিমাসহ সঙ্গে থাকা আন্দোলনকারীরা তাঁকে উদ্ধার করে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই দিন রাতেই একটি পিকআপে করে সাইফুলের লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি ফেরেন বোন। পরদিন সকালে স্থানীয় গুজিরকোনা উচ্চবিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হয়।
চোখের সামনে গুলিতে ভাইয়ের মৃত্যু কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না লিমা আক্তার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার চোখের সামনেই ভাইয়াকে পুলিশ গুলি করল। ভাইয়ার পাশে আমি ছিলাম, বুকে গুলি লাগার সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়া লুটিয়ে পড়েন। বুক দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হচ্ছিল। হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন। এখনো বিশ্বাস হয় না ভাই পৃথিবীতে নাই। এক মুহূর্তের জন্যও তাঁকে ভুলতে পারছি না।’
লিমা আক্তার বলেন, ‘৩ আগস্ট বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর রাতে আমাকে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কথা বলেন। আমি তাঁকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলে ভাইয়া বলছিলেন, “সফলতা নিয়েই বাড়িতে ফিরবেন, না হয় আমার লাশ যাবে।”’ এই কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন লিমা।
সাইফুলের মা খোদেজা খাতুন বলেন, ‘বিদেশ থাইক্কা দেশে ফিইরা ছেলে আমারে ফোন দিয়া কইছিল, “আম্মা, ঢাকার অবস্থা খুব খারাপ। হাসিনা সরকারের পতন ঘটাইয়া বাড়িত আইয়াম। তুমি চিন্তা করো না।” আমার পুত বাড়িত আইল ঠিকই কিন্তু লাশ হইয়া। মা হইয়া ছেলের লাশ দেহন যে কী কষ্ট এটা বোঝাতে পারব না। আল্লাহ আমারে মৃত্যু দিল না ক্যারে! আমার মতো এমন সন্তানহারা যেন আর কেউ না হয়—এই দোয়া করি।’
বিরিশিরি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সাইফুল খুবই ভদ্র ও ভালো ছেলে ছিলেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে মারা যাওয়ায় পরিবারটি এখন খুবই বিপদে পড়েছে।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এম রকিবুল হাসান বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে সাইফুল ইসলাম নামের এক প্রবাসী মারা গেছেন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁর পরিবারকে ২৫ হাজার টাকার চেক দেওয়া হবে। এ ছাড়া পরিবারটিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হবে।