কক্সবাজারের রামু উপজেলার রাজারকুল ইউনিয়নের মৌলভীপাড়ায় পাহাড়ঘেরা একটি একতলা পাকা বাড়ি। আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে বাড়িটিতে ঢুকতেই কানে ভেসে এল এক নারীর আর্তনাদ, ‘ও আল্লাহ, আমার সন্তানদের এমন মৃত্যু কেন হলো, কারে নিয়ে আমি বাঁচব, কেন আমি সন্তানদের বেলুন কিনে দিলাম।’
দুই সন্তান নিখোঁজ হওয়ার পরই মা কামরুন্নাহারের মনে শঙ্কার মেঘ ভর করেছিল। তাদের মৃত্যুসংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষীণ আশাটুকুও শেষ হয়ে যায়। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে ৩০০ গজ দূরে রেললাইনের পাশের একটি ডোবার ধারে কামরুন্নাহারের দুই সন্তান রিহাব আবদুল্লাহ (৭) ও মারিয়া জান্নাত (৫) গিয়েছিল বেলুন নিয়ে খেলতে। সন্ধ্যায় এক জেলের জালে উঠে আসে দুজনের নিথর দেহ। এই খবর জানার পর থেকেই ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যাচ্ছেন কামরুন্নাহার।
মৌলভীপাড়ায় কামরুন্নাহারের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর শাশুড়ি সালেহা বেগম (৬০)। দুই নাতি-নাতনির জন্য চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছিল তাঁর। কাছে গিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। জানালেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে মায়ের কিনে দেওয়া বেলুন ওড়াতে দুই ভাই-বোন রেললাইনের পাশের খোলা মাঠে যায়। এর পর থেকে দুজনের খোঁজ মিলছিল না।
সালেহা জানান, তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আবদুল্লাহ সৌদি আরবের জেদ্দায় থাকেন। ১০ বছর আগে কামরুন্নাহারকে বিয়ে করেন আবদুল্লাহ। তিনি মাঝেমধ্যে দেশে আসা-যাওয়া করেন। নির্জন পাহাড়ি এলাকার একতলা বাড়িটি তৈরি করেছেন কয়েক বছর আগে। এখনো চুনকামের কাজ শেষ হয়নি। ঘরটিতে ছেলের বউ আর তিন নাতি-নাতনিকে নিয়ে সালেহা বসবাস করে আসছিলেন।
সালেহা বলেন, কামরুন্নাহারের তিন সন্তানের মধ্যে একসঙ্গে দুজনের মৃত্যু হলো। বেঁচে রয়েছে কেবল তিন মাস বয়সী মোহাম্মদ দাউদ। মৃত সন্তানদের জন্য দিনরাত দরজা বন্ধ করে কান্না করছেন কামরুন্নাহার। তাঁর দুই চোখ ফুলে গেছে, গলার স্বর ভেঙে গেছে, বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন, তবু কান্না থামছে না।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রেললাইনের পাশের ডোবাতে মাছ ধরতে যান স্থানীয় জেলে হাসমত উল্লাহ। ডোবায় জাল ফেলার পর তিনি বুঝতে পারেন জালে ভারী কিছু আটকা পড়েছে। বড় কোনো মাছ ভেবে খুশিতে তাঁর মন ভরে উঠেছিল। তবে জাল ওপরে তুলতেই তাঁর আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসেন। জালে দেখতে পান দুই শিশু রিহাব আবদুল্লাহ ও মারিয়া জান্নাতের লাশ।
স্থানীয় রাজারকুল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুফিজুর রহমান বলেন, একসঙ্গে দুই ভাই-বোনের মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বৃহস্পতিবার রাতেই দুজনের লাশ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
নিহত শিশু রিহাব আবদুল্লাহ বাড়ির অদূরে অবস্থিত আশরাফিয়া মঈনুল উলুম মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণিতে পড়ত। ভাইয়ের সঙ্গে মাদ্রাসায় আসা-যাওয়া করত বোন মারিয়া জান্নাত।
স্থানীয় ইউপি সদস্য এরশাদ উল্লাহ বলেন, রেললাইনের পাশের জায়গাটি খোলা মাঠ ছিল। ইটভাটার জন্য মাটি কাটতে গিয়ে ডোবায় পরিণত হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে সেটি অনেকটা পুকুরের মতো আকার ধারণ করে।
নিহত শিশুদের দাদি সালেহা বেগম বলেন, ‘শুনেছি সুতা ছিঁড়ে যাওয়ায় বেলুনটি ডোবার পানিতে পড়ে যায়।’ সেটি তুলে আনতে গিয়েই তাঁর দুই নাতি-নাতনির মৃত্যু হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘ছয় মাস আগে নাতি-নাতনিদের নিয়ে ওমরাহ করতে গিয়েছিলাম। তাদের বাবা জানিয়েছিল, পবিত্র ঈদুল আজহায় বাড়িতে আসবে। এখন বাড়িতে ফিরে ওদের বাবা কী দেখবে, সন্তানদের কই পাবে। সবকিছু অন্ধকার করে দিয়ে দুই নাতি-নাতনি চলে গেল।’