প্রায় তিন যুগ আগে বিশ্বনাথ সরকার ও অঞ্জনা সরকারের বিয়ে হয়। তখন অভাবের সংসার। মাটির ঘরে নড়বড়ে পাটখড়ির বেড়া। আয়ের একমাত্র উৎস শামুক ও ঝিনুকের চুন তৈরি ও বিক্রি। চুন তৈরির কাজে স্বামীকে সহযোগিতা করেন অঞ্জনা। ওই আয় দিয়ে তাঁদের সংসার চলেছে। দুই ছেলেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন এ দম্পতি।
অঞ্জনা-বিশ্বনাথ দম্পতির বাড়ি দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার জাংগই গ্রামের ভুঁইমালীপাড়ায়। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে চুন তৈরি ও বিক্রির করেন বিশ্বনাথ সরকার। তাঁদের মতো ভুঁইমালীপাড়ায় ১২টি পরিবার চুন তৈরি ও বিক্রি করে সংসার চালায়। চুনের কারিগরদের কেউ তৈরি করেছেন পাকা ঘর। কারও বাড়িতে রঙিন টিভিরও দেখা মিলছে। এসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা বিদ্যালয়েও যাচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই পাড়া থেকে ১৯৯৩ সালে প্রথম একজন এসএসসি পাস করেন। বর্তমানে ১০ জন শিক্ষার্থী মাধ্যমিকে ও ১৫ জন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ছে। তারা শিক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।
চুন বিক্রির টাকায় সংসার চলে বিশ্বনাথ সরকারের। তাঁর বড় ছেলে উজ্জ্বল সরকার ও ছোট ছেলে উৎপল সরকার স্নাতকোত্তর করেছেন। উজ্জ্বল এখন বগুড়া শহরে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছোট ছেলে উৎপল সরকার রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর করে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
চুনের কারিগর বিপুল সরকার ১৯৯৩ সালে জাংগই উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন। বর্তমানে তিনিও চুন তৈরি ও বিক্রির টাকায় সংসার চালান। তাঁর বড় মেয়ে নয়মী রানী গ্রামের একটি মাধ্যমিকে বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
এ পাড়ায় চুন তৈরি ও ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন শ্যামল সরকার, নরেশ সরকার, বাবু সরকার, কার্তিক সরকার, নেপাল সরকার, বিশ্বনাথ সরকার, কুটিল সরকার, নরেন সরকার, উজ্জ্বল সরকার ও সুরেন সরকার। তাঁরা বাপ-দাদার কাছ থেকে চুন তৈরির কৌশল ও ব্যবসা শিখেছেন। এখন তাঁরা চুন তৈরির দক্ষ কারিগরে পরিণত হয়েছেন।
সম্প্রতি জাংগই গ্রামের ভুঁইমালীপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, নেপাল চন্দ্র সরকার (৫২) বাড়ির বারান্দায় বসে নাদনা হাতে চুন তৈরি করছেন। বারান্দায় সাজিয়ে রাখা হয়েছে সাদা পলিথিনে মোড়ানো ১০, ২০ ও ৩০ টাকা দামের চুনের প্যাকেট। নেপাল চন্দ্রের পাশে বসে চুন তৈরির কাজে সহযোগিতা করছেন তাঁর স্ত্রী।
আলাপচারিতায় নেপাল চন্দ্র জানান, তিনি তাঁর বাবা নিমাই চন্দ্র সরকারের কাছ থেকে চুন তৈরি কাজ শিখেছেন। তাঁর বাবা এ কাজ শিখেছেন দাদা বাবুরাম সরকারের কাছে। প্রতি সপ্তাহে বগুড়া শহর থেকে ঝিনুকের খোল কেনেন তিনি। শামুক বা ঝিনুকের খোলস রোদে শুকিয়ে মাটির চুল্লিতে আগুনে পোড়ানো হয়। সনাতন পদ্ধতিতে শামুক ও ঝিনুকের খোল দিনরাত আগুনে পুড়িয়ে চুনের ঘানিতে রেখে সেগুলো নাদনা দিয়ে গুঁড়া করেন। তারপর তাতে পানি মেশান। পানি মেশানো ঝিনুকের গুঁড়াকে পরিষ্কার করার জন্য তাতে ফিটকিরি ও অ্যাসিড মেশান। এভাবে সেগুলো প্রায় তিন ঘণ্টা রেখে বাঁশের হাতা দিয়ে নাড়লেই পাওয়া যায় সাদা ধবধবে চুন। পরে সাদা কাপড় দিয়ে ছেঁকে পানি ও ঝিনুকের অপ্রয়োজনীয় অংশ আলাদা করে চুন বিক্রির জন্য বড় পাত্রে সংগ্রহ করেন।
বিশ্বনাথ সরকার জানান, বগুড়া শহর থেকে তিনি শঙ্খ কিনে আনেন। প্রতি বস্তার (৬০ কেজি) দাম ৫ হাজার ২০০ টাকা। এক মণ শঙ্খ দিয়ে চার মণ চুন হয়, যার দাম প্রায় ৭ হাজার টাকা।
ভুঁইমালীপাড়ায় তৈরি চুনের সুনাম রয়েছে। এখানকার কারিগরেরা প্রতি রবি ও বৃহস্পতিবার হিলি হাটে চুন বিক্রি করেন। এ দুই দিনে তাঁরা চুন তৈরি করেন না। সপ্তাহের অন্য দিনে কারিগরেরা আশপাশের বিভিন্ন উপজেলায় পাইকারি দরে চুন সরবরাহ করেন।
চুনের কারিগর বিশ্বনাথ সরকার ওরফে ঝড়ু প্রথম আলোকে বলেন, ‘চুন তৈরি হামার বাপ-দাদার ব্যবসা। মোর বাপ মহিম চন্দ্র সরকার খুব ভালো চুন তৈরি করবার পারোছলো (পারতেন)। মুই মোর বাপের কাছোত চুন বানা শিখিছু। বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে মুই চুন বানাও। চুনের ব্যবসার লাভের ট্যাকা দিয়ে হামার সংসার চলে। চুনের ট্যাকায় মুই মোর দুই ব্যাটার লেখাপড়ার খরচ জোগায়ছু।’
বিশ্বনাথ সরকার জানান, বগুড়া শহর থেকে তিনি শঙ্খ কিনে আনেন। প্রতি বস্তার (৬০ কেজি) দাম ৫ হাজার ২০০ টাকা। এক মণ শঙ্খ দিয়ে চার মণ চুন হয়, যার দাম প্রায় ৭ হাজার টাকা।
নেপাল চন্দ্র সরকার বলেন, ‘দিন দিন তো চুন তৈরির খরচ বাড়োছে। পুরান পদ্ধতিতে চুন বানিয়ে এখন আর আগের মতো লাভ হয় না। এখন চুন তৈরির মেশিন কিনে পাওয়া যায়। মেশিনের দামও তো ম্যালা; ৬০ থেকে ৭০ হাজার ট্যাকা। এত ট্যাকা দিয়ে মেশিন কিনাও তো হামার পক্ষে সম্ভব না। সরকার থেকে যদি মেশিন কিনার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে মেশিন দিয়ে আরও বেশি চুন তৈরি করা যাবে, লাভও বেশি হবে।’
হাকিমপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। ভুঁইমালীপাড়ার চুনের কারিগরদের পল্লি সমাজসেবা কার্যক্রমের আওতায় সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে একবারে ১০ থেকে ১২ জনকে ঋণ দেওয়ার সুযোগ নেই। ঋণ নিতে চাইলে তাঁদের তিনটি ধাপে ঋণ দেওয়া হবে।