প্রত্যক্ষদর্শী বললেন, ছাত্রলীগ আমাকে কক্ষ থেকে বের করে দিয়ে কৃষ্ণকে নির্যাতন করে

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
ফাইল ছবি

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে কৃষ্ণ রায় নামের এক ছাত্রকে হলের কক্ষে আটকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনায় একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য পাওয়া গেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ওই শিক্ষার্থীকেও ছাত্রলীগ গালিগালাজ করে তাঁর মুঠোফোন কেড়ে নিয়ে কক্ষ থেকে বের করে দেন। পরে তিনি বাইরে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের নির্যাতনের কথাবার্তা শুনেছেন।

এর আগে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন কৃষ্ণ রায়। অভিযোগে নির্যাতনের পাশাপাশি ওই শিক্ষার্থীকে শিবির আখ্যা দিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। কৃষ্ণ রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোলাইমানসহ ছাত্রলীগের সাত থেকে আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। এর আগে গত রোববার রাতে কৃষ্ণ রায়কে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা নির্যাতন করেন বলে লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শী ওই শিক্ষার্থীর নাম মাহবুব বিল্লাহ। তিনিও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একই বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ওই হলের ৪৪৫ নম্বর কক্ষে থাকেন। ঘটনা চলাকালে তিনি দুই দফা কৃষ্ণ রায়ের কক্ষে ও ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলামের কক্ষে যান। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাংবাদিক সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত আছেন।

মঙ্গলবার দেওয়া অভিযোগে কৃষ্ণ রায় উল্লেখ করেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসক প্রদীপ কুমার পাণ্ডের সুপারিশে ৬ ফেব্রুয়ারি থেকে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ৩৮৩ নম্বর কক্ষে আছি। গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলামের সাত থেকে আটজন অনুসারী আমার রুমে এসে আমাকে বের হয়ে যেতে হুমকি দেয়। আমি রাজি না হলে আমার বিছানা ফেলে দিয়ে আরেকজনকে তুলে দেয় তারা। এ সময় সোলাইমান নামের এক ছাত্রলীগ নেতা আমাকে মারধর করেন। এরপর আমাকে সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলামের রুমে নিয়ে মারধর ও মানসিক নির্যাতন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম বলেন, “তোকে মেরে শিবির বলে চালিয়ে দেব।” কিন্তু আমি হিন্দু জানার পর বলেন, “এখন তো তোকে মেরে ফেললেও কেউ কিছু করতে পারবে না।”’

তবে এ বিষয়ে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলাম নির্যাতন ও হুমকির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।  

প্রত্যক্ষদর্শী মাহবুব বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা কক্ষে এসে ঝামেলা করতে পারেন, বিষয়টি গত রোববার কৃষ্ণ আঁচ করতে পেরেছিলেন। কৃষ্ণ তখনই বিষয়টি তাঁকে জানিয়েছিলেন। রোববার রাত ১০টার দিকে কৃষ্ণ তাঁকে কল দেন। তখন তিনি হলের নিচে ছিলেন। কল পেয়ে তিনি দ্রুত কৃষ্ণের কক্ষে গিয়ে দেখেন, ছাত্রলীগের কয়েকজন কৃষ্ণের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছেন। কৃষ্ণ ঘটনাটি মুঠোফোনে ভিডিও করার চেষ্টা করছিলেন। কিছু সময় পর ছাত্রলীগের কর্মীরা সেখান থেকে চলে গেলে তিনিসহ কৃষ্ণ বিভাগের বড় ভাইদের বিষয়টি জানান। পরে তিনিও কৃষ্ণের কক্ষ থেকে বের হয়ে যান।

রাত সাড়ে ১০টার পর মাহবুব তাঁর ব্লক থেকে কৃষ্ণের কক্ষের সামনে কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেন। দূর থেকে আওয়াজ পেয়ে মাহবুব সেখানে ছুটে যান। তিনি ওই কক্ষে যাওয়ার আগেই কৃষ্ণকে হল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের কক্ষের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করে। পরে তিনি তাঁদের পিছু নেন।

মাহবুব বলেন, ‘সেখানে যাওয়ার পর আমাকে কক্ষে প্রবেশ করতে দেবে না। তবুও আমি জোর করে গেছি। তখন আমার ফোনটা ওরা কেড়ে নেয়। ফোন কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদ করলে ছাত্রলীগ বলতে থাকে, “তুমি ভাই সাংবাদিকতা করো, ভিডিও-টিডিও করলে সমস্যা।” এরপরও কক্ষে থাকতে চাইলে ছাত্রলীগ বলতে থাকে, “আমরা ডেকেছি ওকে। তোমাকে তো ডাকিনি। তুমি বের হয়ে যাও।” তখন তাঁরা উল্টাপাল্টা গালিগালাজ করে জোর করে ওই কক্ষ থেকে আমাকে বের করে দিয়ে কক্ষ আটকিয়ে দেয়।’ মাহবুবকে ছাত্রলীগ নেতা নাঈম ও সোলাইমান এসব কথা বলেছেন।  

ওই কক্ষে কৃষ্ণকে প্রায় ২৫ মিনিট আটকে রাখা হয় জানিয়ে মাহবুব বলেন, ‘বাইরে আসার পরও আমাকে ফোন ফেরত  দেয়নি। কৃষ্ণের ফোন তো আরও আগে কেড়ে নিয়েছে। পরে আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। তখন ছাত্রলীগ কৃষ্ণকে বলতেছে যে, “এই কান ধরে ওঠবস কর।”’

কৃষ্ণ রায়ের বাড়ি নীলফামারী। তাঁর বাবা নেই। দুই বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। টানাটানির সংসারে মেসে থেকে তাঁর পড়াশোনা চালানো কঠিন ছিল। এ কারণে তিনি জনসংযোগ দপ্তরের প্রশাসকের সুপারিশে হল প্রাধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে হলে ওঠেন। কৃষ্ণ প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছু লিখিত অভিযোগে আনেননি তিনি। তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহারের চিত্র তুলে ধরার জন্য তিনি ভিডিও করছিলেন। তাঁরা তখন চুল ধরে টানাটানি করছিলেন। পরে নাঈমের কক্ষে নিয়ে মারধর করার পাশাপাশি কান ধরতে বলেন। পা ধরে মাফ চাইতেও বলেন। তাঁরা ফোনের সবকিছু চেক করেন। মাহবুবের ফোনও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল ওই সময়।

এ বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, তাঁরা আজকেই এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবেন। কমিটি দ্রুত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে হল প্রশাসন দ্রুত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।