মানুষের পদভারে মুখর থাকে হাওরাঞ্চল

সারা দেশে আজ মঙ্গলবার নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর কিশোরগঞ্জের হাওর। সম্প্রতি ইটনার বড় হাওর এলাকায়

প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর হাওর-বাঁওড়–নদীবেষ্টিত জেলা কিশোরগঞ্জ। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে হাজারো মানুষের পদভারে মুখর থাকে হাওরাঞ্চল। হাওরে শুষ্ক মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, ধূলিওড়া মেঠোপথও আকর্ষণ করে পর্যটকদের।

হাওরে বর্ষা থাকে বছরের প্রায় ছয় মাস। পানি আসতে শুরু করে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে। শেষ হয় আশ্বিন-কার্তিকে। বাকি কয়েক মাস এখানে শুকনাকাল।

কি শুকনা, কি বর্ষাকাল—ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সৌন্দর্যের বিপুল পসরা সাজিয়ে বসে থাকে কিশোরগঞ্জের হাওর। বর্ষায় হাওর হয়ে ওঠে কূলহীন সাগর। বিশাল জলরাশির বুকে বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর একেকটাকে ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়।

হাওরজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি হিজলগাছ মন কাড়ে যে কারও। পানির নিচ থেকে জেগে ওঠা করচের বন সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দেয়।

বর্ষা–পরবর্তী শরতে হাওরে যখন পানি কমা শুরু হয়, তখন থেকেই আকাশে সাদা মেঘের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাজার হাজার ধবল বুকেরও ওড়াউড়ি শুরু হয়। আসতে শুরু করে পরিযায়ী পাখি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিলে ফোটে সাদা শাপলা। শুষ্ক মৌসুমে পুরো হাওর হয়ে যায় দিগন্তবিস্তৃত সবুজ প্রান্তর। যেখানেই চোখ যায়, সবুজ আর সবুজ। শরতে পরিযায়ী পাখির আগমন হাওরকে আরও আন্দোলিত করে তোলে।

কিশোরগঞ্জের হাওর উপজেলা ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম ও নিকলীতে রয়েছে কয়েকটি বেড়িবাঁধ। এসব বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে তাকালে ৩০-৩৫ কিলোমিটারের মধ্যে কোনো গ্রাম চোখে পড়ে না। বাঁধে দাঁড়িয়ে হাওর দেখা সাগর দেখার মতোই উপভোগ্য। এসব বেড়িবাঁধে বর্ষায় হাজার হাজার পর্যটক এসে ভিড় জমান। প্রতি বর্ষাতেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ ঘুরতে আসেন বেড়িবাঁধে। তাদের মধ্যে করিমগঞ্জের চামড়াঘাট, বালিখলা, ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সংযোগ সড়ক। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রামে যোগোযোগের জন্য নির্মিত হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সড়ক। দেশের কোথাও হাওরের মাঝখানে এমন সড়ক নেই। নয়নাভিরাম সৌন্দর্য, বিনোদন আর প্রশান্তির এক অনন্য ঠিকানা হয়ে উঠেছে হাওরের এই অল-ওয়েদার রোড।

পর্যটকদের সমাগমে এই অঞ্চলে দরিদ্র বেকার তরুণ-যুবকদের কর্মসংস্থানের নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। অনেক তরুণ মোটরবাইক, ইজিবাইকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন চালিয়ে যাত্রী পরিবহনের মাধ্যমে প্রতিদিন অর্থ উপার্জন করছেন। একশ্রেণির পেশাদার মাঝি নৌকা, ট্রলার ও স্পিডবোটের মাধ্যমে পর্যটকদের পরিভ্রমণ করিয়ে অর্থ উপার্জনের সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থা সহজ হওয়ায় পণ্য পরিবহনের ব্যয় আগের তুলনায় অনেক কমে এসেছে।

এদিকে সারা দেশে আজ মঙ্গলবার নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হচ্ছে বিশ্ব পর্যটন দিবস। এসব কর্মসূচিতে বক্তারা পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকায় নানা সুযোগ–সুবিধা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।

মিঠামইন সদরের বাসিন্দা মোজাহিদুল ইসলামসহ কয়েকজন বলেন, গত বছর দেশের দূরদূরান্ত থেকে মানুষ দল বেঁধে এসেছিলেন কিশোরগঞ্জের হাওরের বিভিন্ন মনোরম স্থানে। বর্ষাজুড়েই ছিল ভ্রমণপিপাসুদের কোলাহল। উচ্ছ্বাস আর আনন্দে মাতোয়ারা ছিল হাওরাঞ্চল। ছিল বিপুলসংখ্যক পর্যটকের আনাগোনা। তবে এবার অতিরিক্ত গরম ও বন্যায় পর্যটক তেমন আসেনি। এর কারণ হিসেবে তিনি মনে করেন, হাওরাঞ্চলগুলোতে পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা এখনো গড়ে ওঠেনি। ফলে ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের আবাসন, খাওয়াদাওয়াসহ নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। হাওরে পর্যটকদের জন্য রাত্রিযাপন, খাওয়াদাওয়া এবং আনন্দ বিনোদনের সুব্যবস্থা রাখা অত্যন্ত জরুরি।

হাওর ট্রাভেল এক্সপ্রেসের স্বত্বাধিকারী তরুণ উদ্যোক্তা মোস্তাফিজ মারুফ বলেন, তিনি এবার হাওরের কয়েকটি পর্যটকদের দল নিয়ে ভ্রমণ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠান মূলত গাইড হিসেবে কাজ করে। পাশাপাশি ভ্রমণকারীদের খাবার, নৌকাসহ প্যাকেজ নিয়ে নেন। তবে গতবারের তুলনায় এবার তাঁর পর্যটকের সংখ্যা অনেক কম ছিল। এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, এবার অতিরিক্তি গরম, বন্যা ছাড়াও নৌকার মাঝিদের সিন্ডিকেট, অতিরিক্ত নৌকাভাড়া অন্যতম। এ ছাড়া এবার পর্যটকদের নজর অনেকটা ছিল পদ্মা সেতু ও টাঙ্গুয়ার হাওরের দিকে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম বলেন, হাওরে ভ্রমণকে আরও পরিবেশবান্ধব করার জন্য তাঁদের নানা পরিকল্পনা রয়েছে।