প্রতিবছর রোজা এলেই নানান স্বাদের ইফতারির পসরা নিয়ে বসেন খুলনা নগরের ব্যবসায়ীরা। এর পাশাপাশি অভিজাত হোটেলেও চলে নানা আয়োজন। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। খুলনায় প্রচলিত ইফতারসামগ্রীর পাশাপাশি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে রেশমি জিলাপি, বিক্রিও হচ্ছে দেদার। পাশাপাশি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে নগরের মানুষের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে ‘নানা হালিম’।
তবে ৩০-৪০ বছর আগেও ইফতারে এত পদের আয়োজন হতো না বলে জানান খুলনা সরকারি ব্রজলাল (বিএল) কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ জাফর ইমাম। তাঁর বয়স এখন ৮৩ বছর। স্বাধীনতার আগে ও পরের ইফতারের স্মৃতি এখনো তাঁর মনে জ্বলজ্বল করছে।
জাফর ইমাম স্মৃতি হাতড়ে বললেন, ৪০-৫০ বছর আগে খুলনার মানুষ ইফতারে অবধারিতভাবে রাখতেন চিড়ার সঙ্গে নারকেল কোরা ও আখের গুড়। এগুলো সারা দিনের রোজার ক্লান্তি দূর করত। এর সঙ্গে ছিল ছোলা, মুড়ি, পেঁয়াজু, বেগুনি, পায়েসসহ নানান পদ। সবকিছুই তৈরি হতো বাড়িতে।
বাইরে থেকে কিনে খাওয়ার প্রচলন ছিল না। বাড়িতে যা তৈরি হতো, তা নিয়েই পরিবারের সবাই একসঙ্গে বসে ইফতার করতেন। এর মধ্যে একটা সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হতো। সারা দিন রোজার পর ইফতারকে সবাই খুব গুরুত্ব দিতেন, এর মধ্যে ছিল ধর্মীয় অনুশাসনও।
জাফর ইমামের মতে, এখন ইফতারের নামে হয় অনেক খাবারের আয়োজন। রোজার সময় বিভিন্ন সংগঠনের ইফতার করার ধুম পড়ে। আলোচনায় আসার প্রবণতাও বেশ বেড়েছে।
দুপুরের পর থেকে চালু হয়ে যায় ইফতারির বাজার। তবে ভিড় বাড়তে শুরু করে আসরের নামাজের পর। এসব ইফতারির বাজারে বিক্রি হচ্ছে আলু ও ডিমের চপ, পাকোড়া, কলার মোচার চপ, সবজির চপ, ফুলুরি, হালিম, চানা মসলা, ঘোল, মাঠা, ফিরনি, পিঠা, শাহি জিলাপিসহ আরও অনেক কিছু। নগরের অভিজাত ইফতারির দোকানগুলোতে বিক্রি হচ্ছে দইবড়া, ক্রিসপি চিকেন, চিকেন ললি, চিকেন গ্রিল, চিকেন ফ্রাই, চিকেন টিক্কা, চিকেন রোস্ট, গরু ও খাসির কাবাব, চিকেন কিমা কাবাবসহ হরেক রকম খাবার। মিষ্টিজাতীয় খাবারের মধ্যে খুলনার বিশেষত্ব হচ্ছে ফিরনি, পায়েস, হরেক রকম জিলাপি ও পাটিসাপটা পিঠা। তবে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত আইটেম হচ্ছে হালিম ও রেশমি জিলাপি। একসময় গুটিকয় দোকানে এ দুটি আইটেম বিক্রি হলেও এখন প্রায় সব দোকানেই বিক্রি হচ্ছে।
রেশমি জিলাপি
আকারে ছোট, গড়নে চিকন মচমচে আর কম মিষ্টির জিলাপির নাম রেশমি জিলাপি। ১৫ প্যাচের এই রেশমি জিলাপি দিন দিন খুলনায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে প্রকৃত স্বাদ পেতে হলে যেতে হবে নগরের ফেরিঘাট মোড়ে। সেখানেই আট-নয় বছর ধরে তৈরি হচ্ছে এই জিলাপি। মাষকলাইয়ের ডাল, পোলাও চালের গুঁড়া, ঘি, বেসনসহ নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা হয় রেশমি জিলাপি।
ফেরিঘাট মোড়ে এই জিলাপি তৈরি করেন সেলিম সুইটসের মালিক মো. বুলু। তিনি জানালেন, রোজার সময় এই জিলাপি বেশি চলে। গড়ে প্রতিদিন ৫০ কেজি পর্যন্ত জিলাপি বিক্রি হয়।
নানা হালিম
শুধু রমজানেই হালিম বিক্রি করেন মো. হযরত আলী। তাঁর তৈরি হালিম ‘নানা হালিম’ নামে খুলনা শহরে ব্যাপক পরিচিত। ইফতারে জনপ্রিয়তার শীর্ষেও সেটি। প্রতিদিন ১০০-১৫০ কেজি পর্যন্ত রান্না হয় নানা হালিম। খাসির মাংস দিয়ে রান্না করা ওই হালিম কিনতে ভিড় শুরু হয় দুপুর থেকেই।
হযরত আলী পেশায় একজন বাবুর্চি, বয়স প্রায় ৮০। তবে তাঁর মূল নামটি ঢাকা পড়ে গেছে ‘নানা হালিম’ নামের আড়ালে। প্রায় ৩১ বছর ধরে হালিম বিক্রি করলেও প্রায় এক যুগ ধরে শুধু রমজান মাসেই হালিম বিক্রি করেন তিনি। খুলনা নগরের সাউথ সেন্ট্রাল রোডের সরকারি পাইওনিয়ার মহিলা কলেজের সামনের ফুটপাতে কাপড় দিয়ে দোকানের মতো তৈরি করে সেখানেই বিক্রি হয় তাঁর হালিম। হালিমের মান ঠিক রাখতে এখনো হযরত আলী নিজ হাতেই রান্না করেন। তবে উপকরণের দাম বাড়ায় এবার হালিমের দামও বেড়েছে। সর্বনিম্ন ২০০ টাকা থেকে শুরু হয়েছে হালিমের দাম। ৩০০, ৫০০, ৮০০ ও ১ হাজার ৮০০ টাকা মূল্যের হালিম পাওয়া যায় সেখানে।