বুলবুল কবির ছেলে আলিফকে (১৫) নিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যেতেন। ৫ আগস্ট বাবাকে ছাড়াই আলিফ আন্দোলনে যোগ দিতে রওনা হয়। মা তানিয়া আক্তার ছেলেকে যেতে নিষেধ করেন। তখন আলিফ বলেছিল, ‘আমি যদি মারাও যাই, তুমি তো শহীদের মা হবা।’ মা বলেছিলেন, ‘শহীদের মা হওয়ার দরকার নাই, তুমি বাসায়ই থাকো।’
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর আনন্দমিছিলে যোগ দেয় আলিফ আহমেদ (সিয়াম)। ঢাকার সাভারের থানাস্ট্যান্ড এলাকায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়। ৭ আগস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আলিফের মৃত্যু হয়।
তানিয়া আক্তার ও বুলবুল কবির দম্পতির ছেলে আলিফ। তাঁরা সাভারের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়–সংলগ্ন ইসলামনগর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন। আলিফ সাভারের ডেইরি ফার্ম হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
গতকাল বুধবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, ইসলামনগর এলাকায় নিহত আলিফের বাসায় স্থানীয় লোকজনের ভিড়। তাঁরা আলিফের মা তানিয়া আক্তারকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। বুলবুল কবিরের পাশে আছে আলিফের বন্ধুরা। ক্যাম্পাসের জয় বাংলা ফটকসংলগ্ন এলাকায় ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করেন বুলবুল কবির। দুই কক্ষের বাসায় একটিতে থাকত আলিফ; আরেক কক্ষে থাকেন মা–বাবা আর ছোট বোন ইসরাত। ছেলের খাটে বসে ছিলেন মা তানিয়া আক্তার। তাঁর কোলে রয়েছে মেয়ে ইসরাত। তানিয়া আক্তার নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন ছেলের পড়ার টেবিলের দিকে। একপর্যায়ে ছেলের সঙ্গে নানা স্মৃতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন তিনি।
শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে তানিয়া আক্তার বলেন, ‘এতটুকু বয়সে সে (আলিফ) বুঝেছিল মাকে কীভাবে ভালোবাসতে হয়। সে আমার বন্ধু ছিল; মা–বাবার মতো ছিল। আমার কষ্ট হলে সান্ত্বনা দিত; চোখের পানি মুছিয়ে দিত।’
তানিয়া আক্তার আরও বলেন, ‘তার (আলিফ) স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। পাইলট হয়ে সেই উড়োজাহাজে করে আমাদের হজে নিয়ে যাবে বলেছিল। আমি যখন ঘুমাইতাম, সে মশারি টানিয়ে দিত, মাথার কাছে মোবাইল রেখে দিত। পাশের টেবিলে পানি রেখে দিত। যাদের কারণে আমার বুক খালি হয়েছে, তাদের বিচার চাই। মৃত্যুর আগে তাদের ফাঁসি দেখে যেতে চাই।’
আলিফের পড়ার টেবিলের পাশের দেয়ালে স্কচটেপ দিয়ে উত্তর কোরিয়ার রহস্যময় রুম থার্টি নাইন, যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ব্রাদার্স আইল্যান্ড, মস্কোর মেট্টোরেল-২, ব্রাজিলের স্নেক আইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশের দর্শনীয় স্থানের বিভিন্ন পত্রিকার কাটিং লাগানো আছে। তানিয়া আক্তার জানান, আলিফের ইচ্ছা ছিল বিভিন্ন দেশের সুন্দর সুন্দর জায়গা ভ্রমণ করার। সে ইচ্ছা আর পূরণ হলো না।
সোফায় চুপচাপ বসে ছিলেন আলিফের বাবা বুলবুল কবির। তিনি জানান, শুরু থেকে ছেলেকে নিয়ে আন্দোলনে যেতেন। ওই দিন (৫ আগস্ট) আলিফ বেলা ১১টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাভারে যায়। পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলি হলে সে সেখান থেকে সিঅ্যান্ডবি এলাকায় ফিরে আসে। শেখ হাসিনার পতনের খবর জানান পর আনন্দমিছিল নিয়ে আবার গণভবনের উদ্দেশে রওনা দেয় আলিফ। থানাস্ট্যান্ড এলাকায় পুলিশ গুলি করে। বিকেলে ছেলে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানতে পারেন তাঁরা। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আলিফকে পান তাঁরা।
ওই দিনের স্মৃতিচারণা করে বুলবুল কবির বলেন, ‘শেষের দিন (৫ আগস্ট) আমি মুঠোফোন দিয়ে আলিফকে বলেছিলাম সাবধানে থাইকো। ওর মা আটকিয়েছিল। সে বলছিল “আমি যদি মারাও যাই, তুমি তো শহীদের মা হবা।” ওর মা বলেছিল, “শহীদের মা হওয়ার দরকার নাই, তুমি বাসায় থাকো।” এরপরও সে চলে গিয়েছিল।’
এখন আমি ওর বয়সী কারও দিকে তাকাতে পারি না। দেখলেই আমার আলিফের কথা মনে পড়ে। আমার সন্তানকে আর ফিরে পাব না। আমি হত্যাকারীদের বিচার চাই।বুলবুল কবির, নিহত আলিফের বাবা
বুলবুল কবির আরও বলেন, ‘স্বপ্ন ছিল ওর (আলিফ) পড়াশোনা শেষ হলে ভালো একটা কিছু করবে। আমাদের সব দুঃখ দূর হবে। এখন আমি ওর বয়সী কারও দিকে তাকাতে পারি না। দেখলেই আমার আলিফের কথা মনে পড়ে। আমার সন্তানকে আর ফিরে পাব না। আমি হত্যাকারীদের বিচার চাই।’