খুলনার রূপসা উপজেলার জাবুশা এলাকায় সালাম জুট মিলে আগুনে মালপত্র ও যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলা
খুলনার রূপসা উপজেলার জাবুশা এলাকায় সালাম জুট মিলে আগুনে মালপত্র ও যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে তোলা

খুলনায় পাটকলে আগুন

সাব্বির-রহিমাদের চোখে-মুখে ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা

খুলনার রূপসার সালাম জুট মিলের পুড়ে যাওয়া পাটের সুতার স্তূপ থেকে তখনো ধোঁয়া উড়ছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন গুদামের পাশে দাঁড়িয়ে ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতা দেখছেন ওলিউর রহমান। পাটকলের শ্রমিক মাঝবয়সী ওলিউরের মুখটা বড়ই বিষণ্ন। ঈদ কীভাবে কাটবে, আগামীর দিনগুলো কীভাবে চলবে, তা নিয়ে তাঁর দুশ্চিন্তা। এই চিত্র গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার।

পাশের ফকিরহাট উপজেলার লখপুর বারুইডাঙ্গা থেকে কাজে আসতেন ওলিউর। বছর ছয়েক ধরে এই মিলে কাজ করেন। কাছে গিয়ে আলাপ তুলতেই মলিন মুখে ওলিউর বলেন, ‘এই কাজ চলে সংসার চলে। মিল পুড়ে যাওয়ার পরও আমাদের বিল দেওয়ার কথা বলেছে; তবে কখন কী হবে কে জানে? সামনে ঈদ। ছয়-সাতটা পেট কীভাবে চলবে, বুঝতে পারছি না। নিরুপায় হয়ে গেলাম।’

বুধবার রূপসা উপজেলার জাবুসা এলাকার সালাম জুট মিলে আগুন লাগে। সাত ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। বৃহস্পতিবার দিনভর ধোঁয়া ও তাপ নিয়ন্ত্রণ (ডাম্পিং ডাউন) কাজ চলে। পাটকল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, আগুনে গুদামে থাকা পাটের তৈরি নানা ধরনের পণ্য, অন্যান্য মালামাল ও যন্ত্রপাতি পুড়ে শতকোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
আগুনে পুড়ে যাওয়া ওই পাটকলে ওলিউরের মতো আরও ৩৫০ শ্রমিক কাজ করতেন। তাঁদের সবার চোখে-মুখে এখন উদ্বেগ। তাঁদের মধ্যে সাপ্তাহিক বেতন, ঈদের বোনাস পাওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তা যেমন আছে, তেমনি নতুন করে কাজ খুঁজে পাওয়া নিয়েও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

মিলের তরুণ শ্রমিক সাব্বির হাসান হতাশা হয়ে বলেন, ‘আসছে সোমবার বেতন–বোনাস দিয়ে ঈদের ছুটি হওয়ার কথা ছিল। আমরা সবাই খুশির মধ্যে ছিলাম। পরিবার, স্বজন সবাই মিলে আনন্দ করব। কিন্তু আগুনে পুড়ে সব স্বপ্ন শেষ। কোম্পানি শেষ, আমরাও শেষ। কবে কারখানা চালু হবে, তা বুঝতে পারছি না।’

ঈদ ঘিরে যে আশা ছিল, সেই আশাই মাটি হয়ে গেল। বেতন–বোনাস যদি পাই, তারপরও পুরো ঈদটাই চিন্তায় কাটবে। হঠাৎ করে নতুন কাজ পাওয়াটা সহজ নয়।
আশরাফুল ইসলাম, শ্রমিক

তবে হতাশাটা বেশি নতুন কাজ খোঁজা নিয়ে। খুলনায় শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নতুন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ না তৈরি হওয়ায় কাজ পাওয়াটা এমনিতেই অনেক কঠিন হয়ে গেছে। সাব্বির হাসান বলছিলেন, ‘নতুন কাজকাম পাওয়া খুবই কঠিন। আবার সামনে ঈদ; সব দিক দিয়েই চাপ। বেতন-বোনাসের চেয়ে চিন্তা হচ্ছে আগামীতে কোথায় কী করব, তাই নিয়ে। বড় কথা হচ্ছে সামনে কীভাবে চলব?’

বটিয়াঘাটার বাইনতলা গ্রামের বাসিন্দা আশরাফুল ইসলাম সাত বছর ধরে ওই পাটকলে কাজ করেন। সেখানে কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এসেছিল তাঁর। আশরাফুল ইসলাম বলেন, ঈদ ঘিরে যে আশাটা ছিল, সেই আশাই মাটি হয়ে গেল। বেতন–বোনাস যদি পাই, তারপরও পুরো ঈদটাই চিন্তায় কাটবে। হঠাৎ করে নতুন কাজ পাওয়াটা সহজ নয়।

খুলনার রূপসা উপজেলার জাবুশা এলাকায় সালাম জুট মিলের অবস্থান

মিলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন রহিমা বেগমসহ কয়েকজন নারী শ্রমিক। তাঁরা ভেতরে ঢুকতে চাচ্ছিলেন। তবে প্রহরীদের বাধার কারণে যেতে পারছিলেন না। কাছে এগিয়ে যেতেই রহিমা বেগম বলেন, ‘সবই তো পুড়ে গেল। খুব হতাশ লাগছে। মনটা খারাপ হয়ে আছে। চিন্তা করে আর করব কী? ওপর ওয়ালার ওপর সব ছেড়ে দিছি। এসব দুর্ঘটনার ওপর আমাদের তো আর হাত নেই।’

শ্রমিকেরা ঠিক সময়েই বেতন-বোনাস পাবেন বলে জানিয়েছেন পাটকলের জ্যেষ্ঠ উৎপাদন কর্মকর্তা শেখ হাফিজুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত মিলে সাড়ে তিন শর মতো শ্রমিক কাজ করেন। ঘটনার সময় ২০০ জনের মতো কাজ করছিলেন। শ্রমিকদের ঈদের বোনাস দেওয়া হয়নি। তবে অবশ্যই তা দেওয়া হবে। মালিকপক্ষ বলেছে, এটা নিয়ে ঝামেলা হবে না। আর সাপ্তাহিক মজুরি কাল–পরশুর মধ্যে দিয়ে দেওয়া হবে। শ্রমিকদের অসুবিধা হয়, এ রকম কিছু করা হবে না।