বরিশাল-পটুয়াখালী বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, পরিচয়পত্র দেখানো সাপেক্ষে শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশ ভাড়া মওকুফ করা হবে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে ও হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের বাসভাড়া দিতে হবে না।
আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টায় বরিশাল নগরের রূপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় এ ঘোষণা দেন মালিক সমিতির সদ্য দায়িত্ব নেওয়া আহ্বায়ক ও মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার।
তবে স্থানীয় বিএনপির আরেকটি পক্ষ বলছে, গত শুক্রবার রাতে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ডে তিন চাকার যান চালকদের কাছে চাঁদা না পাওয়ায় তাঁদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনা ধামাচাপা দিতেই এ আয়োজন। এসব সিদ্ধান্ত রূপাতলী বাস টার্মিনালের দখল পাকাপোক্ত করার অপকৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।
পরিবহন শ্রমিকেরা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালে এই বাস মালিক সমিতির সভাপতি ছিলেন ২৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সুলতান আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মহানগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য কাওছার হোসেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁরা আত্মগোপনে চলে গেলে মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার বাস মালিক সমিতির আহ্বায়কের দায়িত্ব নেন।
একই সঙ্গে রূপাতলী বাস শ্রমিক ইউনিয়নের আওয়ামী লীগপন্থী কমিটির নেতারা আত্মগোপন করলে সমিতির দায়িত্ব নিয়েছেন জিয়া উদ্দিন সিকদারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ও ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সহসভাপতি পরিচয় দেওয়া কালাম চৌধুরী। রূপাতলীর এই বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতিদিন দক্ষিণাঞ্চলের ২২টি রুটে যাত্রীসেবা দেয় বরিশাল-পটুয়াখালী বাস ও মিনিবাস মালিক সমিতির বাস। এসব রুটে তিন শতাধিক বাস চলাচল করে।
জানা যায়, রোববার বেলা ১১টার দিকে রূপাতলী বাস টার্মিনাল এলাকায় মিছিল করেন বাসমালিক, শ্রমিক ও পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এ সময় তাঁদের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও দেখা যায়। মিছিল শেষে জিয়া উদ্দিন সিকদার বলেন, গত ১৫টি বছর যাঁরা বাস টার্মিনালগুলো নিয়ন্ত্রণ করেছেন তাঁরা একচেটিয়া চাঁদাবাজি করে এই খাতের সুনাম নষ্ট করেছেন। আজ থেকে তিনি এই টার্মিনালকে চাঁদাবাজমুক্ত ঘোষণা করলেন।
তিনি সমাবেশে আরও বলেন, আন্দোলনে যেসব ছাত্র আহত হয়েছেন তাঁদের বিনা মূল্যে বরিশাল-পটুয়াখালী রুটে বাসে চড়ার সুযোগ দিতে চান। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়সহ নগরের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, তাঁরা সেখানকার কর্তৃপক্ষ এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তাঁরা তালিকা দিলে সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে পরিচয়পত্র প্রদর্শন সাপেক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য ৫০ শতাংশ ভাড়া মওকুফ করা হয়েছে।
তিন চাকার যানের কয়েকজন চালক বলেন, এসব ‘মনভোলানো’ ঘোষণা চালকদের ওপর হামলার বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য করা হয়েছে। শ্রমিক ইউনিয়ন দখল নেওয়ার পর কালাম চৌধুরীর লোকজন রূপাতলী বাস টার্মিনালসংলগ্ন তিন চাকার স্ট্যান্ডের দখল নিয়ে চাঁদা আদায় করতে যান। তবে এতে বাধা দেন ২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক রাজীব মোল্লা। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গত শুক্রবার রাতে কালাম চৌধুরীর লোকজন তিন চাকার যানবাহনের চালকদের ওপর হামলা চালান। এতে ১২ জন আহত হয়েছেন। এ নিয়ে রূপাতলী বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দুই দিন ধরে বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। এর মধ্যেই রোববার দুপুরে বাসমালিক, শ্রমিক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে সমাবেশ করলেন নগর বিএনপির আহ্বায়ক জিয়া উদ্দিন সিকদার।
তাঁরা আরও অভিযোগ করেন, রূপাতলী বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও শ্রমিক দলের ২৫ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সহসভাপতি কালাম চৌধুরীসহ তাঁদের লোকজন টার্মিনালের প্রতিটি বাস থেকে (প্রতিবার টার্মিনাল থেকে ছাড়তে) ১০০ থেকে ১২০ টাকা করে চাঁদা তোলা শুরু করেন।
অবশ্য কালাম চৌধুরী গতকাল শনিবার বলেন, ‘আমি একজন পেশাদার শ্রমিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের বৈধ সাধারণ সম্পাদক। রাজীব মোল্লা আমার বাস শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যালয় দখল করার জন্য তিন চাকার যানের শ্রমিকদের নিয়ে শুক্রবার রাতে হামলা চালান। তখন বাস শ্রমিকেরা তা প্রতিরোধ করেন। এখানে চাঁদা দাবির বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট।’
তবে কালাম চৌধুরী নিজেকে ২৫ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সহসভাপতি পরিচয় দিলেও ওই ওয়ার্ডে শ্রমিক দলের কোনো কমিটি নেই বলে জানান জেলা শ্রমিক দলের আহ্বায়ক ফয়েজ আহমেদ খান। তিনি রোববার বলেন, ‘শ্রমিক দলের নামে কেউ কোনো স্ট্যান্ড বা সমিতি অবৈধভাবে দখল কিংবা চাঁদাবাজি করলে সংগঠন তাঁর দায় নেবে না এবং এটা বরদাশত করা হবে না।’
বিএনপি নেতা রাজীব মোল্লা বলেন, রূপাতলী বাস টার্মিনালসংলগ্ন তিন চাকার যানবাহন স্ট্যান্ডটি তাঁর মার্কেটের সামনের জমিতে। তাই তিন চাকার যানের চালকেরা তাঁর কাছে এসে তাঁদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি শ্রমিকদের কোনো রকম কাউকে চাঁদা না দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু কালাম চৌধুরী ও তাঁর লোকজন চাঁদা তোলার ব্যাপারে অনড় ছিলেন। শুক্রবার রাত পৌনে ১০টার দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে তিন চাকার স্ট্যান্ডে চালকদের ওপর হামলা চালান কালাম চৌধুরীর লোকজন। তিনি খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। পরে আহত চালকদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেন।
রাজীব আরও বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়ন দখল করে নেওয়ার ঘটনায় আমি দলের ভাবমূর্তির স্বার্থে বাধা দেওয়ায় দখলদারেরা নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে আজ কিছু শিক্ষার্থী ও চাঁদাবাজ শ্রমিকদের নিয়ে লোকদেখানো এই মিছিল ও সমাবেশ করেছে। কিন্তু আমরা চাই, বাসস্ট্যান্ড অবৈধ দখলমুক্ত থাকুক এবং দলের নামে কেউ যেন দখল করে চাঁদাবাজি করতে না পারে, সেটা প্রশাসন নিশ্চিত করুক। আমাদের দলের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। কিন্তু সেই হুঁশিয়ারি ও নির্দেশনা বরিশালে উপেক্ষিত হচ্ছে।’