নির্বাচনের আগে-পরে নৌকা ও কাঁচির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে একের পর এক সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে। দলের কর্মীরা বর্তমানে দুই ভাগে বিভক্ত।
‘দোকানে বসে আছি, হঠাৎ করেই দেখি বাজারে লোকজন লাঠিসোঁটা ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন। তখন বুঝতে পারি, অশান্তি বেধেছে।’ অশান্তি মানে কী, জানতে চাইলে জবাব এল, ‘অশান্তি বুঝলেন না? একদলের দুই পক্ষের, মানে কাঁচি ও নৌকার লোকজনের মধ্যে গন্ডগোল বেধেছে। নির্বাচনের আগে ও পরে এমন অশান্তি চলছে। দুই পক্ষের অশান্তিতে পুলিশ এসে ঘোরাঘুরি করছে। তবু অশান্তি থামছেই না।’
চা–দোকানি মোজাফফর হোসেন (৬২) যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন তিনি এদিক-ওদিক দেখছিলেন। মোজাফফর হোসেনের চায়ের স্টল জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের মাত্রাই বাজারে। গত বুধবার বিকেলে মাত্রাই বাজারে গিয়ে দোকানি ও বাজারের আশপাশের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমন ‘অশান্তি’ বা নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার কথা জানা গেছে।
স্থানীয় লোকজন ও থানা-পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাত্রাই ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ন ম শওকত হাবিব তালুকদার। আরেক পক্ষে আছেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মনোয়ার হোসেন। গত ইউপি নির্বাচনে মনোয়ারকে হারিয়ে শওকত হাবিব জয় পান। তখন থেকে তাঁদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন।
দলের কর্মীরা বলেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়পুরহাট-২ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ দলীয় মনোনয়ন পান। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাহফুজ (কাঁচি) চৌধুরী দলীয় মনোনয়ন চেয়ে না পেয়ে এ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। চেয়ারম্যান শওকত স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে মাঠে নামেন। আর মনোয়ার হোসেন নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন। প্রতীক বরাদ্দের পরপরই বাজারে পোস্টার টানানো নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত হয়। নির্বাচনের আগে নৌকা ও কাঁচির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে একের পর এক সংঘাতের ঘটনা ঘটে।
নির্বাচনের আগে ও পরে এমন অশান্তি চলছে। দুই পক্ষের অশান্তিতে পুলিশ এসে ঘোরাঘুরি করছে। তবু অশান্তি থামছেই না।মোজাফফর হোসেন, চা–দোকানি
নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম মাহফুজ হেরে যান। নির্বাচনের পর কাঁচি ও নৌকা প্রতীকের কর্মী-সমর্থকেরা দফায় দফায় সংঘাতে জড়ান। কাঁচি প্রতীকের কর্মীর আলুর খেত উপড়ে ফেলা ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। ১৬ জানুয়ারি রাতে নৌকা প্রতীকের কর্মী সোহাগকে কুপিয়ে জখম করা হয়। এ ঘটনায় রাতেই ইউপি কার্যালয়ে চেয়ারম্যান হাবিবকে অবরুদ্ধ করেন প্রতিপক্ষের লোকজন। একপর্যায়ে নৌকা ও কাঁচি প্রতীকের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। এতে দুই পক্ষের ছয়জন আহত হন। তিনটি মোটরসাইকেল ভাঙচুর করা হয়। থানায় পাল্টাপাল্টি দুটি মামলাও হয়।
স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, সংঘাত এড়াতে মাত্রাই বাজারে পুলিশ টহল জোরদার করা হয়। এরই মধ্যে বুধবার রাতে কাঁচির সমর্থক ও কুসুমসারা গ্রামের বাসিন্দা সাদ্দাম হোসেনকে পিটিয়ে আহত করা হয়। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে জয়পুরহাট ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মাত্রাই ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হাবিব বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করায় আমার ও আমাদের লোকজনকে বারবার টার্গেট করে মারপিট করা হচ্ছে। এসব ঘটনায় মামলা করেছি।’
স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম মাহফুজ চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বলেন, নির্বাচনের পর নৌকার কর্মী-সমর্থকেরা তাঁর লোকজনের ওপর হামলা চালাচ্ছেন। মাত্রাই ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি তাঁর কর্মী-সমর্থকেরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। যাঁদের নির্যাতন করা হচ্ছে, তাঁরাও আওয়ামী লীগই করেন। যেন স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করা তাঁদের অপরাধ।
এ বিষয়ে সংসদ সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তাঁর সমর্থক মনোয়ার হোসেন বলেন, মাত্রাই ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকেরা মাত্রাইয়ের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মারধর করছেন। তবে তাঁরা সহনশীলতা দেখাচ্ছেন।
কালাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওয়াসিম আল বারী গতকাল বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে মাত্রাই ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় নৌকা ও কাঁচির কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। এ ঘটনায় দুই পক্ষই পাল্টাপাল্টি মামলা করেছে। দুই পক্ষের দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।