ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে আজ সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তার আহ্বান জানানো হয়
ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে আজ সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তার আহ্বান জানানো হয়

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

ময়মনসিংহে সংবাদ সম্মেলনে আহত ব্যক্তিদের পরিবারকে জরুরি সহায়তার আহ্বান

কেউ ক্রাচে ভর করে হাঁটেন, কারও হাতে-পায়ে ও মাথায় ব্যান্ডেজ। প্রায় দুই মাস ধরে তাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তাঁরা গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। সুস্থ হতে কত সময় লাগবে, তা তাঁরা জানেন না। তাঁদের মধ্যে অনেকে ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। অর্থাভাবে তাঁদের পরিবার চরম কষ্টে আছে। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবে আজ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন এলাকায় আহত হয়ে অনেকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ১৮ জন আজ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। বেলা সাড়ে ১১টায় সংবাদ সম্মেলন শুরু হয়। এ সময় আহত ব্যক্তিরা তাঁদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তার অনুরোধ করেন।

আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তোফাজ্জল হোসেন (৩৫) পেশায় ভ্যানচালক। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার। পরিবার নিয়ে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা এলাকায় থাকতেন। বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশালে। সরকার পতনের পর ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গিয়ে তিনি ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। এর পর থেকে তিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

তোফাজ্জল হোসেন বলেন, চিকিৎসা ও খাবার হাসপাতাল থেকে দেওয়া হচ্ছে। তবে স্ত্রী-সন্তান পড়েছে কষ্টে। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। ইতিমধ্যে তাঁর ভ্যান বিক্রি করে দিয়েছেন। দাদনেও আনা হয়েছে টাকা। সংবার কীভাবে চলবে, তা বুঝতে পারছেন না।

ফুলবাড়িয়া উপজেলার দেওখোলা গ্রামের ইদ্রিস আলীর ছেলে রবিউল ইসলাম (৩০)। পেশায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক। গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় রিকশা চালাতেন তিনি। বাবা, মা, স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে তাঁর সংসার। গত ২০ জুলাই পায়ে গুলিবিদ্ধ হন রবিউল। পরে ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি হন। এখন তাঁকে ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হয়, পায়ে তীব্র যন্ত্রণা।

রবিউল ইসলাম বলেন, রিকশা চালিয়ে সংসার চলত। তাঁর রিকশা বিক্রি করতে হয়েছে। ৭০ হাজার টাকা দাদনে নিয়ে খরচ করতে হয়েছে। এভাবে আর সংসার চলছে না।
কিশোরগঞ্জের হোসেনপুরে বাড়ি আমিনুল হকের। বসবাস করতেন গাজীপুরের শ্রীপুরের মুলাইদ গ্রামে। সেখানে তাঁর ওষুধের দোকান। ৫ আগস্ট আনন্দ মিছিলে মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় ডান পায়ে গুলিবিদ্ধ হন আমিনুল। স্ত্রী-সন্তানসহ ছয় সদস্যের পরিবার নিয়ে এখন কষ্টে পড়েছেন। বাসাভাড়াও দিতে পারছেন না।

আমিনুল হক বলেন, ‘পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কেউ নেই। ঢাকায় হাসপাতালগুলোতে আহত ব্যক্তিরা সহায়তা পেলেও আমরা পাচ্ছি না। আমার পা ঠিক হতে অন্তত এক বছর লাগবে।’

মামুনুর রশিদের বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে। তিনি মাওনার একটি মাদ্রাসার পরিচালক ছিলেন। ২০ জুলাই আন্দোলনে অন্তত ৫৪টি রাবার বুলেট লাগে তার। এর পর থেকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে ১৪টি রাবার বুলেট বের করা হয়েছে। তিনি জানান, আন্দোলনে যোগ দেওয়ার কারণে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাঁর পরিবার খুব কষ্টে আছে।

মনিরুলের মাথায় থাকা রাবার বুলেট অস্ত্রোপচার করে গতকাল বুধবার বের করা হয়েছে। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন তিনি। ২২ বছর বয়সী মনিরুল ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বাসিন্দা। নারায়ণগঞ্জের চাষারা এলাকায় তৈরি পোশাক কারখানায় শ্রমিকের কাজ করতেন। সেখানেই ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন। শরীরে ১০০টির বেশি গুলি লাগে জানিয়ে মনিরুল বলেন, ‘স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে আমার সংসার ছিল। আমার এ অবস্থার কারণে স্ত্রী-সন্তানকে এখন বাবা দেখাশোনা করছে।’

নেত্রকোনা সদর উপজেলার বাসিন্দা মো. রিয়াদ (১৮) রডমিস্ত্রি হিসেবে কাজ করতেন উত্তরায়। ২১ জুলাই তিনি গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর বাবা মারা গেছেন। মা, ছোট ভাই ও বোনকে নিয়ে তাঁর সংসার। রিয়াদ বলেন, ‘আমি সংসার চালাইতাম। গুলি খাওয়ার পর এর মধ্যে ৬০ হাজার টাকা দাদনে নিয়ে পরিবার চলতাছে।’

একই কষ্টের কথা জানান পোশাকশ্রমিক মনিরুল, মেহেদী হাসান, সোহেল মিয়াসহ অন্যরা।

সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ময়মনসিংহের সমন্বয়ক আল নূর মোহাম্মদ (আয়াস) বলেন, বর্তমানে হাসপাতালে ২০ জন রোগী ভর্তি আছেন, যাঁরা আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫ জনেরই পরিবার রয়েছে। অন্যরা শিক্ষার্থী। আহত ব্যক্তিরা স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারছেন না।

আল নূর মোহাম্মদ আরও বলেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে তাঁরা আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা দিনমজুর, যাঁরা ভ্যান চালান, তাঁদের পরিবারের জন্য জরুরি সহযোগিতা দরকার। তাঁদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নিজ উদ্যোগে সমাজের হৃদয়বান ব্যক্তিদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, আহত ব্যক্তিদের অনেকে পা, হাত বা চোখ হরিয়েছেন, তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিন। আহত ব্যক্তিদের ভাতার ব্যবস্থা করে দিন এবং খুনিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনুন।