সরকার খুচরা পর্যায়ে প্রতি ডজন ডিম ১৪২ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু পাবনা ও সিরাজগঞ্জে প্রতি ডজন ডিম ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
পাবনায় খামার থেকে বাজারে পৌঁছাতে প্রতি ডজন ডিমের দাম ২০ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে কয়েকটি মুরগির খামার ও পাইকারি ডিমের বাজার ঘুরে এ তথ্য জানা গেছে। সিরাজগঞ্জে খামার থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসা পর্যন্ত ডিমের দাম প্রতি ডজনে ৩০ থেকে ৩৬ টাকা পর্যন্ত বাড়ছে।
পাইকারদের দাবি, খামার থেকে ডিম সংগ্রহের পর পরিবহন ও শ্রমিক খরচের কারণে দাম একটু বাড়ছে। ডিমের দাম বাড়ায় নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এতে বেশি সমস্যায় পড়েছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। তাঁরা সরকারের কাছে দ্রুত ডিমের দাম কমানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে জেলা সদরের মালিগাছা ইউনিয়নের জোতগাছা গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, পাবনা-ঈশ্বরদী মহাসড়কের মালিগাছা বাজার থেকে কিছু দূর এগিয়েই ডান দিকে গ্রামটি। বড় রাস্তা থেকে সরু রাস্তায় নামতেই দুই দিকে চোখে পড়ে মুরগির খামার। এখানে অনেক ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির খামার আছে।
গ্রামের আলতাফ পোলট্রি খামারের মালিক মো. আলতাফ হোসেন জানান, তাঁর খামারে বর্তমানে প্রায় ২৩ হাজার মুরগি আছে। প্রতিদিন ডিম উৎপাদিত হচ্ছে ২২ হাজার। তাঁরা খামার থেকে সরকার-নির্ধারিত ১১ টাকা দরে প্রতিটি ডিম বিক্রি করছেন। এতে প্রতি ডজন ডিমের দাম হচ্ছে ১৩২ টাকা।
ডিমের দাম অনেক বেশি। এক হালি ডিম নিয়েছি ৬০ টাকায়। ভেবেছিলাম নতুন সরকার এসেছে, এখন নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক হবে। কিন্তু কিছুই হলো না। এখনো সবকিছুর দাম শুধু বেড়েই চলছে।মরিয়ম পারভীন, ক্রেতা, সিরাজগঞ্জ সদর
আলতাফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বাজারে ডিমের চাহিদা বাড়লে দাম বাড়ে, চাহিদা কমলে দাম কমে। বর্তমানে সবজির মূল্যবৃদ্ধিতে ডিমের চাহিদা কিছুটা বেড়েছে। এতে দামও বেড়েছে।
একই এলাকার মুরগির খামারের মালিক আবদুল হান্নান জানান, তিনি খামার থেকে ১৩২ টাকা ডজন ডিম বিক্রি করছেন। তবে এই দাম থাকবে না। চাহিদা কমলে দাম কমতে থাকবে।
জেলা সদরের সবচেয়ে বড় পাইকারি ডিমের বাজার টেবুনিয়া আড়তে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকা থেকে ভ্যান, ইঞ্জিনচালিত নসিমন করিমনযোগে ডিম আনা হচ্ছে। আড়তে প্রতিটি ডিম ১২ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এখানে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৫৬ টাকা দরে। খামার থেকে পাইকারি আড়তে ডিমের দামে পার্থক্য ২০ থেকে ২৫ টাকা।
পাইকারি ডিম ব্যবসায়ী সাইদুর রহমান জানান, খামার থেকে ডিম সংগ্রহের পর পরিবহন ও শ্রমিক বাবদ তাঁদের কিছু ব্যয় হয়। অন্যদিকে ভেঙে কিছু ডিম নষ্ট হয়। ফলে ডজনে অন্তত ২০ টাকা লাভ না হলে তাঁদের কিছুই থাকে না। অপর পাইকারি ব্যবসায়ী খাইরুল কবির বলেন, ‘বর্তমানে ডিমের বাজার পড়তির দিকে। আজ যে দামে ডিম কেনা হচ্ছে, সে দামে বিক্রি করা যাবে কি না, তা নিয়ে তাঁরা শঙ্কিত।’
পাইকারি বাজার থেকে জেলা শহরের খুচরা বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, প্রতি ডজন ডিম ১৫৮ থেকে ১৬০ টাকা ডজন বিক্রি হচ্ছে। দোকানভেদে ডিমের দামে কিছুটা কমবেশি রয়েছে।
শহরের খুচরা ডিম বিক্রেতা সাদ্দাম হোসেন বলেন, তাঁরা প্রতিটি ডিমে ৫০ পয়সা পর্যন্ত লাভ করেন। এতে প্রতি ডজনে ৫-৬ টাকা পর্যন্ত লাভ হয় তাঁদের।
এ প্রসঙ্গে পাবনা জেলা পোলট্রি খামার মালিক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা সব সময় সরকার-নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করি। দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা হয়েছে। অন্যদিকে বাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এতেই বর্তমানে ডিমের চাহিদা বেড়ে দাম কিছুটা বেড়েছে। বর্তমানে খামারে খরচও বেড়েছে। ফলে আমরা খুব বেশি লাভের মুখ দেখছি না।’
আমরা সব সময় সরকার-নির্ধারিত দামে ডিম বিক্রি করি। দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা হয়েছে। অন্যদিকে বাজারে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এতেই ডিমের চাহিদা বেড়ে দাম বেড়েছে।মোহাম্মদ আলী, সভাপতি, পাবনা জেলা পোলট্রি খামার মালিক সমিতি
গত ১৬ সেপ্টেম্বর কৃষি বিপণন অধিদপ্তর পক্ষ থেকে ডিমের দাম বেঁধে দেওয়া হলেও সিরাজগঞ্জে দুই দিনের ব্যবধানেই প্রতি হালিতে ৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। সেই থেকেই ডিমের দাম বেড়েই চলেছে। ৮ অক্টোবর থেকে পাইকারি বাজারে ব্যবসায়ীরা খামারিদের কাছ থেকে আগের চেয়ে কিছুটা কম দামে ডিম কিনেছেন। তবে স্থানীয় বাজারগুলোয় এখনো খুচরা ডিমের হালি ৬০ টাকা এবং প্রতি ডজন ১৭০-১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ পৌর বড় বাজার ও রেলস্টেশন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়, যা সরকারের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে প্রায় ২৮ টাকা বেশি। এখানে কেউ যদি এক ডজনের কম কিনতে আসেন, সে ক্ষেত্রে প্রতি পিসের দাম ১৫ টাকা, যা ডজন হিসেবে গিয়ে দাঁড়ায় ১৮০ টাকায়। অন্যদিকে ব্রয়লার মুরগির সাদা ডিমের ডজনও ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে গত সপ্তাহে সাদা ডিমের ডজন ছিল ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকা। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ১০ টাকা করে বেড়েছে। মূলত বেশি লাভবান হচ্ছেন পাইকারি দোকানি, আড়তদার ও খুচরা দোকানিরা।
সোমবার সকালে বড় বাজারের এক দোকানে ডিম কিনতে এসে মরিয়ম পারভীন নামের এক ক্রেতা বলেন, ডিমের দাম অনেক বেশি। এক হালি ডিম নিয়েছি ৬০ টাকায়। ভেবেছিলাম নতুন সরকার এসেছে, এখন নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক হবে। কিন্তু কিছুই হলো না। এখনো সবকিছুর দাম শুধু বেড়েই চলছে।
বড় বাজারে ডিম ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত রোববার পাইকারি বিক্রেতার কাছ থেকে প্রতিটি ডিম ১৩ টাকায় কিনেছি, এর সঙ্গে আছে পরিবহন খরচ। এ ছাড়া প্রতিনিয়তই বেশ কিছু ডিম নষ্ট হয়। এসব হিসাব করেই আমাদের বিক্রি করতে হয়।
ডিমের আড়তদার রিপন শেখ বলেন, ‘আমরা ডিমের আকারভেদে তিন ভাগে ভাগ করে সে অনুযায়ী দাম কিনে থাকি। গত তিন দিনে বড় ডিম প্রতিটি সর্বোচ্চ ১৩ টাকা ও সর্বনিম্ন ১২ টাকা ৬০ পয়সা করে কিনেছি। মাঝারি ডিম কিনেছি সর্বোচ্চ ১২ টাকা ৬০ পয়সা থেকে ১১ টাকা ৩০ পয়সায়। ছোট ডিম কিনেছি সর্বোচ্চ ১১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে ১০ টাকায়। কেনা দামের সঙ্গে খরচ ও লভ্যাংশ হিসেবে ৫০ পয়সা যোগ করে আমরা পাইকারি বিক্রি করেছি। খুচরা দোকানিরা এই ডিমগুলো নিয়ে আরও বেশি লাভ করে বিক্রি করায় ডিমের দাম আরও বেড়ে গেছে।’
চর কান্দাপাড়া গ্রামের লেয়ার মুরগির খামার মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে ডিমের বাজার চরমভাবে বাড়লেও আমরা ছোট খামারিরা বেশি দাম পাই না। এই বাজারে খামার থেকে আমরা একটি বড় ডিম সর্বোচ্চ ১৩ টাকায়, মাঝারি ১১ টাকায় ও ছোট ডিম ১০ টাকার বেশি বিক্রি করতে পারিনি।’
অপর একটি খামারের মালিক লোকমান হোসেন বলেন, বড় বড় কোম্পানি এবং তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতি মিলে এই ডিমের বাজারটাকে অস্থির করে ফেলছে। প্রান্তিক খামারিরা ডিমের দাম নির্ধারণ করে না। সিন্ডিকেট ডিমের দাম বাড়ালে খামারি বাড়তি দামে বিক্রি করে। সিন্ডিকেট দাম কমালে খামারি কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সিরাজগঞ্জ কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মাহমুদ হাসান বলেন, ডিমের অস্বাভাবিক এই মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে খামারিরাও জড়িয়ে পড়ছেন। যে কারণে খামারিদেরও জরিমানা করা হচ্ছে। বাজারে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির ফলে নানাভাবে সুযোগ নিয়ে মূলত বেশি লাভবান হচ্ছেন আড়তদার ও খুচরা দোকানিরা।