মৃত্যুর আগে সাদেকুর বলেছিলেন, ‘আমার বাচ্চাগুলো দেইখ্যা রাইখো’

সাদিকুর রহমানের কবরের পাশে স্বজনেরা
ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সাদেকুর রহমানকে (২৬) নিষেধ করেছিলেন স্ত্রী। কিন্তু স্ত্রীর কথা তিনি শোনেননি। আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হন সাদেকুর। দুদিন চিকিৎসাধীন থাকার পর তাঁর মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর শেষবারের মতো সাদেকুর কথা বলেন তাঁর বড় ভাইয়ের সঙ্গে। বলে যান, ‘আমার বাচ্চাগুলো দেইখ্যা রাইখো, আমার জন্য দোয়া কইরো।’

সাদেকুর রহমানের বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ইউনিয়নের কালিকাবাড়ি গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের আবুল লতিফের ছেলে। মা ফাতেমা খাতুন মারা গেছেন আগেই। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন সাদেকুর। সাভারে একটি তৈরি পোশাক কারখানায় মসজিদের ইমামতি করতেন।পাশাপাশি কারখানায় কাজও করতেন। স্ত্রী শাহিদা খাতুনকে নিয়ে সাভার এলাকাতেই বসবাস করতেন। পাঁচ বছর বয়সী রুহামা রহমান ও আড়াই বছর বয়সী তাসনোভা তাসনিম নামে দুই মেয়ের বাবা ছিলেন তিনি। দুই বছর ধরে সাভারে বাস করছিলেন সাদেকুর। আগে এলাকায় মাদ্রাসায় চাকরি করতেন।
 
স্বজনেরা জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন সাদেকুর রহমান। ৫ আগস্ট সকাল ১০টার দিকে সন্তানদের সঙ্গে নাশতা খেয়ে বের হয়ে যান। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে পরিবারের কাছে খবর আসে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন সাদেকুর। সাভারের বাইপাইল এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের সময় গুলি লাগে সাদেকুরের পেটে। তাঁর পেটে গুলি লেগে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সেদিন সাদেকুর রহমানের সঙ্গে খালাতো ভাই মিলন ও হাবিবও সঙ্গে ছিলেন। গোলাগুলির এক পর্যায়ে গুলিবিদ্ধ সাদেকুরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান দুই খালাতো ভাই। সাভারের এনাম মেডিকেলে ভর্তি করা হলে ৭ আগস্ট বেলা একটার দিকে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ৮ আগস্ট ময়নাতদন্ত ছাড়াই বাড়িতে দাফন করা হয়।

সাদিকুর রহমান

হাসপাতালে নেওয়ার পথে সাদেকুর রহমানের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল বড় ভাই সাদ্দাম হুসাইনের। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গুলি লাগার পর মুঠোফোনে মাত্র দুটি কথা বলেছিল সাদেকুর। বলেছিল, ‘আমার বাচ্চাগুলো দেইখ্যা রাইখো। আমার জন্য দোয়া কইরো।’ তখন তাকে কালেমা পড়তে বলছিলাম। তারপর পরিবারের আর কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তিনি আরও বলেন, মৃত্যুর পর তার মুঠোফোনে আন্দোলনে অংশ নেওয়ার ভিডিও দেখেছি।’

সাদেকুরের মৃত্যুতে মর্মাহত বাবা আবদুল লতিফ। বাবার চোখের পানি যেন শুকায় না। সব সময় কান্না করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে এভাবে হারাতে হবে কখনো ভাবিনি। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত ভারী তা আমি বুঝেছি।’

সাদেকুর মারা যাওয়ার পর দুই সন্তানকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন স্ত্রী শাহিদা খাতুন। আন্দোলনে যেতে নিষেধ করেও ফেরাতে পারেননি স্বামীকে। শাহিদা জানান, সেদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে তিনি (সাদেকুর) বাচ্চাদের সঙ্গে নাশতা করেন, খেলা করেন। পরে দ্রুত বের হয়ে যান। সেদিন যাওয়ার সময় নিষেধ করেছিলাম, কারণ বাইরে বেশি গন্ডগোল ছিল। কিন্তু তিনি তাঁর কথা শোনেননি।

শাহিদা আরও বলেন, ‘তিনি (সাদেকুর) আমাকে বলেন, দেশের মেধাবী ছাত্রদের মেরে ফেলা হচ্ছে। দেশের জন্য যাচ্ছি। বলে যান, “আমি যেন শহীদ হয়ে আসতে পারি, দেশকে স্বাধীন করে আসতে পারি।” তখন আমি বলেছিলাম, যাঁরা আন্দোলনে যাচ্ছেন, তাঁদের তো স্বজন আছে, কিন্তু আমার তো তুমি ছাড়া কেউ নেই। যদি কিছু হয়ে যায়, তখন আমাদের কী হবে? তখন আমাকে বলেন, “আল্লায় দেখবে।” সেদিন মোবাইলও নিয়ে যাননি। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে খবর পাই আমার স্বামীর গায়ে গুলি লেগেছে। অথই সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন তিনি। দুইটা বাচ্চার কী হবে—এই দুশ্চিন্তায় এখন দিন কাটে।’