বঙ্গোপসাগরের মধ্যে আট বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপ সেন্ট মার্টিনের মূল আকর্ষণ সারি সারি নারকেলগাছ। ১ হাজার ৯৭৭ একরের এ দ্বীপের আরেক নাম ‘নারকেল জিঞ্জিরা’। এক যুগ আগেও দ্বীপের ১১ হাজার গাছের নারকেল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন শত শত মানুষ। এখন গাছ আছে মাত্র পাঁচ হাজারের মতো। তাতে ঠিকমতো নারকেল পাওয়া যাচ্ছে না। পর্যটন মৌসুমে দ্বীপে যখন পর্যটকে ভরপুর থাকে, তখন বরিশাল, চাঁদপুর ও কক্সবাজার থেকে ডাব এনে চাহিদা পূরণ করতে হয়। নারকেল উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়ায় মানুষের আয়রোজগারও কমে আসছে। সেই সঙ্গে দ্বীপের পরিবেশগত ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের নারকেলগাছ উজাড় হচ্ছে মূলত দুটি কারণে। গত কয়েক বছরে দ্বীপে হোটেল–মোটেল নির্মাণ করতে গিয়ে কাটা পড়েছে অন্তত চার হাজার গাছ। অথচ ১৯৯৯ সালের পরিবেশ অধিদপ্তর ঘোষিত আইন অনুযায়ী, দ্বীপে অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সাদা মাছির আক্রমণে মড়ক লেগেও নারকেলগাছ মারা যাচ্ছে। গত দুই বছরে দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় মড়ক লেগে মারা গেছে ৮০০টির মতো গাছ। এর পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া এবং পরিচর্যার অভাবেও নারকেলগাছ কমছে বলে দ্বীপের কৃষকেরা জানিয়েছেন।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও চাষিদের দেওয়া তথ্য মতে, গত এক বছরে দ্বীপের কয়েকটি গ্রামে সাদা মাছির আক্রমণে ৫০০টি গাছ মারা গেছে। আগের বছর মারা গেছে আরও ৩০০টি। গত ছয় বছরে দ্বীপের যত্রতত্র শতাধিক হোটেল–রিসোর্ট–কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। তাতে কাটা পড়েছে অন্তত চার হাজার গাছ। এখন দাঁড়িয়ে থাকা কয়েক হাজার গাছের অবস্থাও নড়বড়ে। রোগাক্রান্ত হয়ে যেসব গাছ টিকে আছে, সেগুলোতেও তেমন ফলন হচ্ছে না।
বঙ্গোপসাগরের মধ্যে নির্জন দ্বীপের গাছে গাছে সাদা মাছির উৎপাত কেন বাড়ছে, এ নিয়ে কৃষি বিভাগ কিংবা পরিবেশ অধিদপ্তরের নেই কোনো গবেষণা।
পরিবেশ অধিদপ্তর ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। ইসিএ এর আইন অনুযায়ী, এই দ্বীপে এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যার মাধ্যমে দ্বীপের পানি, মাটি, বায়ু বা প্রাণীর ক্ষতি হয়। এখানে যেকোনো প্রকারের অবকাঠামো নির্মাণও নিষিদ্ধ করা হয়। ২০২২ সালে সরকারঘোষিত আরেকটি প্রজ্ঞাপনে সেন্ট মার্টিনকে মেরিন প্রটেকটেড এরিয়া ঘোষণা করা হয়। তাতে সেন্ট মার্টিনে ইট ও সিমেন্ট নেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। অথচ নারকেল বাগানসমৃদ্ধ লোকজনের বসতবাড়ি ও ফসলি জমি কিনে ইতিমধ্যে ২৩৭টির বেশি হোটেল–রিসোর্ট–কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। দীর্ঘ কয়েক যুগে দ্বীপে প্রবাল প্রজাতি ১৪১টি থেকে কমে ৪০টিতে নেমে এসেছে। কমেছে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা। এই দ্বীপের বর্তমান লোকসংখ্যা ১১ হাজার ৭০০।
টেকনাফ থেকে জাহাজ কিংবা ট্রলারে ৩৪ কিলোমিটারের নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যেতে হয়। দ্বীপে উঠানামার একমাত্র জেটিটি দ্বীপের পূর্বপাশে বাজার এলাকায় অবস্থিত। জেটিতে নামার আগে সারি সারি নারকেলগাছে চোখ যায় সবার।
জেটিঘাট থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে কোনাপাড়া। কয়েক হাজার নারকেলগাছ রয়েছে সেখানে। গত বুধবার দুপুরে সরেজমিন দেখা যায়, বেশ কিছু গাছের পাতা লাল রং ধারণ করেছে। পাতার ওপর মাকড়সার জালের মতো আবরণ। কিছু পাতাতে তুলার মতো পোকার বাসা। অধিকাংশ গাছের গোড়ার মাটি সরে গিয়ে শিকড় ভেসে উঠেছে। গোড়ার মাটিও শুকনা।
২৫৩টি নারকেলগাছে ঘেরা টিনের ছাউনির ঘরে থাকেন স্থানীয় কৃষক সালে আহমদ। গত ২ বছরে তাঁর ভিটার ৫০টি গাছ মরে গেছে। অবশিষ্ট গাছগুলোতেও তেমন নারকেল নেই। কারণ জানতে চাইলে সালে আহমদ (৫৫) বলেন, সাদা মাছির আক্রমণে গাছ মরে যাচ্ছে। বর্ষাকালে মাছির উৎপাত কিছুটা কম থাকে, কিন্তু শীতকালে মাছির উৎপাত অনেক বাড়ে। আসন্ন শীত মৌসুমে (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) বাড়ির আরও গাছ মরে যেতে পারে।
ঘূর্ণিঝড় কিংবা জলোচ্ছ্বাসে কিছু গাছ উপড়ে পড়ার কথা জানিয়ে সালে আহমদ বলেন, পাঁচ বছর আগেও গাছের ডাব বিক্রি করে তিনি বছরে দুই লাখ টাকার বেশি আয় করতেন। গত বছর ডাব বিক্রি করেন ৭৪ হাজার টাকার। এ বছর ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকার বেশি পাওয়া যাবে না। গাছে ডাব ধরা মাত্র মাছির আক্রমণ শুরু হয়। কিছুদিন পর ওই ডাব ঝড়ে পড়ে।
পাশের গ্রাম মাঝের পাড়ার কৃষক আবু তালেব, আমির হামজা, রশিদ আহমদের গাছেরও একই অবস্থা। এই তিন ব্যক্তির বাড়িতে নারকেলগাছ আছে অন্তত ৬০০টি। অধিকাংশ গাছের পাতা লাল রং ধারণ করে আছে।
আমির হামজা (৫২) বলেন, তিন বছর ধরে গাছে সাদা মাছির আক্রমণ দেখা দিয়েছে। দিন দিন মাছির উৎপাত বাড়লেও কৃষি বিভাগ তৎপর নয়। মাছির আক্রমণ কেন হয়, তা জানেন না কৃষকেরা।
ডেইলপাড়ার গৃহবধূ ফাতেমা বেগমের বাড়িতে নারকেলগাছ আছে ৪১টি। ২৩টি গাছে কয়েকটি করে ডাব ধরেছে। অন্যগাছগুলো ডাবশূন্য। ফাতেমা (৪৭) বলেন, গাছের ডাব সাদা মাছি খেয়ে ফেলে। উঁচু গাছে মাছি মারার স্প্রেও করা যায় না।
দ্বীপের গলাচিপা, দক্ষিণপাড়া, পূর্বপাড়া, উত্তরপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, গোড়ার মাটি সরে গিয়ে বেশ কিছু গাছ হেলে পড়েছে। উত্তরপাড়ার জেলে জমির উদ্দিন বলেন, গত জুলাই-আগস্টের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে অন্তত ৪৫টি নারকেলগাছ উপড়ে পড়েছে।
সেন্ট মার্টিনে নারকেলগাছের সংখ্যা কত, এ তথ্য ইউনিয়ন পরিষদে নেই। পরিবেশ অধিদপ্তর, কৃষি বিভাগেও নেই। দ্বীপের ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, এক যুগ আগে ১১ হাজারের বেশি নারকেলগাছ ছিল। এখন পাঁচ-ছয় হাজারের মতো আছে। অবশিষ্ট গাছ হারিয়ে গেছে পোকার আক্রমণ, ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস এবং অবকাঠামো নির্মাণের কারণে। সাদা মাছির আক্রমণে ডাব উৎপাদন কমে আসায় কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে।
দ্বীপের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমদ খান বলেন, ৫ বছর আগেও ৪০ থেকে ৫০ টাকায় গাছের ডাব খাওয়া যেত। ডাবের আকারও ছিল অনেক বড়। এখন ডাব বিক্রি হয় ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায়, আকারও ছোট। শীত মৌসুমে যখন দ্বীপে ৫ থেকে ১০ হাজার পর্যটকের সমাগম ঘটে, তখন বরিশাল-চাঁদপুর, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, আনোয়ারা, কক্সবাজারের ডাব দিয়ে চাহিদা পূরণ করতে হয়।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপে সাদা মাছির উৎপাত বেশি কেন, এ নিয়ে গবেষণার দরকার আছে জানিয়ে টেকনাফ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. জাকিরুল ইসলাম বলেন, সাদা মাছি নারকেল পাতার নিচে বসে রস চুষে খায়। এরপর হানিডিউ নিঃসরণ করে। এর ফলে পাতার ওপর কালির মতো আস্তরণ জমে এবং ওই আস্তরণের ফলে ছত্রাক তৈরি হয়। ফলে গাছের সালোক সংশ্লেষণে বাধা তৈরি হয়। এ জন্য গাছ খাদ্য তৈরি করতে পারে না। তাই গাছের ফলন কমে যাচ্ছে।
জাকিরুল ইসলাম বলেন, শীত মৌসুমে সাদা মাছির উৎপাত বাড়লেও তখন গাছে স্প্রে করা যায় না। কারণ, পর্যটকদের আগমন। ইসিএ এলাকায় স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর স্প্রে করতে সরকারি সিদ্ধান্তেরও প্রয়োজন হয়। তা ছাড়া ৬০ থেকে ৭০ ফুট উঁচু গাছে স্প্রে করতেও সমস্যা। স্প্রে পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর। তারপরও কৃষকদের কীটনাশক প্রয়োগসহ নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।
পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মো. জমির উদ্দিন বলেন, দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে শত শত নারকেলগাছ কেটে দুই শতাধিক হোটেল–রিসোর্ট–কটেজ নির্মাণ করা হয়েছে। এখন যেসব নারকেলগাছ আছে, সেগুলো অধিকাংশ বয়স্ক। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় গাছের গোড়ার মাটি শুকিয়ে সরে যাচ্ছে, গাছের শিকড় বিস্তৃত হতে পারছে না। এ কারণে গাছ মারা যাচ্ছে। তা ছাড়া মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সঠিক পরিচর্যার অভাব, পোকামাকড়ের আক্রমণ ও ভাইরাস সংক্রমণের কারণেও নারকেলগাছের মৃত্যু হচ্ছে। এ নিয়ে গবেষণা দরকার।