সাপ্রু খালের এক পাড়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, অন্য পাড়ে বান্দরবান। খালের সাতকানিয়া অংশে যন্ত্র বসিয়ে বান্দরবানের ভাগ্যকুল এলাকা থেকে বালু টেনে আনা হচ্ছে পাইপ দিয়ে। গত সোমবার দুপুরে তোলা। মংহাইসিং মারমা।
সাপ্রু খালের এক পাড়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, অন্য পাড়ে বান্দরবান। খালের সাতকানিয়া অংশে যন্ত্র বসিয়ে বান্দরবানের ভাগ্যকুল এলাকা থেকে বালু টেনে আনা হচ্ছে পাইপ দিয়ে। গত সোমবার দুপুরে তোলা। মংহাইসিং মারমা।

বান্দরবান

খালের বালু পাচারে একজোট আওয়ামী লীগ-বিএনপি

বান্দরবান ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সীমানায় সাপ্রু খালের অবস্থান। এই খাল থেকে দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে বালু তুলে অবাধে পাচার করছে বান্দরবান সদর ও সাতকানিয়া—এই দুই উপজেলার পাচারকারীরা। বালু পাচারকারীদের মধ্যে বান্দরবানে আওয়ামী লীগের নেতারা যেমন আছেন, তেমনি রয়েছেন বিএনপি নেতা-কর্মীরাও। রাজনৈতিকভাবে প্রতিপক্ষ হলেও বালু তোলার ক্ষেত্রে তাঁরা একজোট। বালু তোলার কারণে খালের ভাঙনে ইতিমধ্যে অনেক পরিবারের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে। প্রশাসন বারবার বালু তোলার যন্ত্র জব্দ কররেও পাচার থামানো যাচ্ছে না।

অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সাপ্রু খালের বান্দরবান অংশ থেকে বালু তোলায় একসঙ্গে কাজ করছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির উভয় দলের নেতারা। অপর দিকে সাতকানিয়া অংশে এই কাজে জড়িত বিএনপির নেতা–কর্মীরা। খালের বালু তোলার কারণে দুই উপজেলায় সাপ্রু খালের তীরে অবস্থিত ফসলের খেত, বসতবাড়ি ভাঙনের মুখে পড়েছে। ফসলের খেতে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত।

বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের ভাগ্যকুল গ্রামে সোমবার দুপুরে দেখা গেছে, সাতকানিয়ার পাচারকারীরা সাপ্রু খালে একটি বালু আহরণ যন্ত্র স্থাপন করেছেন। সাতকানিয়ায় বসানো যন্ত্র দিয়ে বালু টানা হচ্ছে খালের পূর্ব তীরের বান্দরবান সদর উপজেলার ভাগ্যকুল গ্রাম এলাকা থেকে। বান্দরবানের পাচারকারীরা কয়েক দিন ধরে প্রশাসনের চাপে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানান গ্রামবাসী। খালের দুই পাশে বালু তোলার প্রভাবে গ্রামের উত্তর-পূর্ব পাশে প্রায় ৫০ একর জমির মাঝখানে দেবে গিয়ে বিশাল খাদ সৃষ্টি হয়েছে। ওই খাদে পড়ে গরু ও ছাগলের পা ভেঙে যায় বলে জমির এক মালিক জানে আলম জানালেন। সেখানে চাষের অনেক জমি ও ঘরবাড়ি বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।

ভাগ্যকুল গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আমির হোসেন জানান, বালু সন্ত্রাসে খাল ভেঙে গত পাঁচ বছরে ৩০ থেকে ৩৫টি পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে। সর্বস্ব হারা হয়েছে ১০ থেকে ১৫টি পরিবার। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে গ্রামের প্রায় ৩০০ পরিবারের এক-তৃতীয়াংশ। বান্দরবানে সুয়ালক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আরিফ ও ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি আবদুর রহমান মিলেমিশে বালু পাচার করছেন। তাঁদের সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী জড়িত। প্রশাসনের চাপে এখন তাঁরা ভাগ্যকুল এলাকায় বালু তোলা বন্ধ রাখলেও অন্য জায়গা থেকে বালু পাচার করছেন বলে জানান গ্রামবাসী।

আবদুল মালেক নামে আরেকজন বলেন, তাঁর বসতবাড়ি ভেঙে গেছে বালু তোলার কারণে। এখন তিনি বাগানের ভেতর বাড়ি করে রয়েছেন। জানে আলম, নুরুল আলমসহ অনেকে জানান, বালু তোলার কারণে তাঁদের চাষের জমি দেবে গিয়ে খাদে পরিণত হয়েছে। খালের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় সেচ দিতে না পেরে বর্ষাকাল ছাড়া চাষাবাদ বন্ধ হয়ে গেছে।

খালের সাতকানিয়া অংশে বালু আহরণ যন্ত্রের চালক মো. সোহাগ জানালেন, বিএনপি নেতা ও ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. আয়ুবের নেতৃত্বে মিজান, শাহেদসহ বেশ কয়েকজনের বালু ব্যবসায়ীর কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন তিনি। গত সপ্তাহে প্রশাসনের অভিযানে দুটি বালু তোলার যন্ত্র জব্দ হয়েছে। গত রোববার রাতে আরেকটি যন্ত্র বসানো হয়েছে।

ছদাহা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ও ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. আয়ুব অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, সরকার পতনের আগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সাপ্রু খালের কোটি কোটি টাকার বালু পাচার করেছেন। এখন তাঁরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। বিএনপির কিছু নেতা-কর্মী এখন কাজ করছেন। তিনি এতে সরাসরি জড়িত নন।

তবে সুয়ালক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আরিফ বলেন, তাঁরা আগে বালু তুললেও এখন বন্ধ করে দিয়েছেন। যন্ত্র দিয়ে নয়, শ্রমিকের মাধ্যমে স্বল্প পরিমাণ বালু তুলেছেন তাঁরা। সাতকানিয়ার পাচারকারীরা সাতকানিয়ায় মেশিন বসিয়ে লাখ লাখ ফুট বালু তুলে পাচার করায় ভাগ্যকুল এলাকায় পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে বলে তিনি জানান।

এ বিষয়ে বান্দরবান সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফয়সল উদ্দিন জানিয়েছেন, সাপ্রু খালের ভাগ্যকুল এলাকায় বালু উত্তোলন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত সপ্তাহে সাতকানিয়া অংশে সেখানকার প্রশাসন অভিযান পরিচালনা করে বালু তোলার যন্ত্র জব্দ করেছে। আবার যন্ত্র স্থাপন করে থাকলে সাতকানিয়ার প্রশাসনকে জানিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।