নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত

ওপারের ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দে এপারের বাসিন্দারা আতঙ্কে

ফসলি জমির পরের পাহাড়টি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পড়েছে। যেখানে চলছে তুমুল যুদ্ধ। বৃহস্পতিবার সকালে পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তে
ছবি: প্রথম আলো

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু বাজার সীমান্তের বিপরীতে মাত্র দেড়-দুই কিলোমিটার দূরত্বে মিয়ানমারের পাহাড়ি ‘খা মং সেক’ অঞ্চল। ২১ দিন ধরে মিয়ানমারের ওই এলাকায় চলছে তুমুল লড়াই। প্রতিদিন বাড়ছে লড়াইয়ের তীব্রতা। ব্যবহার হচ্ছে ভারী অস্ত্র। সেখানকার গুলি আর গোলার বিকট শব্দে আতঙ্কে দিন কাটছে এপারের বাসিন্দাদের।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সীমান্তের বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে জানা গেছে, মিয়ানমার সীমান্তের রাখাইন রাজ্যের ‘খা মং সেক’ পাহাড়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সে দেশের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’র (এএ) মধ্যে এই লড়াই চলছে। কয়েক দিন ধরে সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেট ফাইটার ও একাধিক হেলিকপ্টারের তৎপরতা বেড়েছে। হেলিকপ্টার থেকে সশস্ত্র গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তুতে ছোড়া হচ্ছে অসংখ্য গুলি ও বোমা। তাতে পাহাড়ের বনাঞ্চল দাউ দাউ করে জ্বলছে।

গত ২৮ আগস্ট দুপুরে মিয়ানমারের দিক থেকে ছোড়া মর্টারের দুটি গোলা বাংলাদেশ অংশে এসে পড়ে। যদিও তাতে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এ ঘটনায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে চলমান স্থলযুদ্ধ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ।

আজ বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার থেকে মর্টার শেল ছোড়ার বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের এখানে এসেছে অ্যাস্ট্রে (পথভ্রষ্ট), হঠাৎ করে চলে এসেছে। এ নিয়ে আমরা তাদের (মিয়ানমার) জিজ্ঞেসও করেছি। তারা আগামীতে আরও সতর্ক হবে।’

পার্বত্য বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বাজারের পাশে উত্তরপাড়ায় গত ২৮ আগস্ট পড়ে ছিল মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার গোলা। বৃহস্পতিবার সকালে মর্টার শেল আঘাত হানার জায়গা দেখাচ্ছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা

তুমব্রু বাজার থেকে ওপারে (মিয়ানমার) একাধিক হেলিকপ্টার, জেট ফাইটারের দৌড়ঝাঁপ, গুলিবর্ষণের দৃশ্য দেখা যায়। এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, আজ বৃহস্পতিবারও সকাল থেকে ওপারে উভয় পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সঙ্গে চলছে আর্টিলারি, মর্টার গোলাসহ ভারী অস্ত্রের ব্যবহার। বেলা দুইটা পর্যন্ত অন্তত চার দফায় তিনটি হেলিকপ্টার থেকে কয়েক শ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে। জেট ফাইটারের চক্করও লক্ষ্য করেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।

আতঙ্কে তুমব্রু এলাকার মানুষের চলাচল সীমিত হয়ে পড়েছে। তুমব্রু বাজারের ব্যবসায়ী আলী আকবর বলেন, কয়েক দিন ধরে পুরো বাজার ফাঁকা যাচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়া মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। ওপারের যুদ্ধের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকায় এপারেও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

দেখা গেছে, তুমব্রু বাজারের কোনারপাড়া এবং মিয়ানমারের ‘খা মং সেক’ পাহাড়ে মধ্যভাগের জায়গাটুকু নো ম্যান্স ল্যান্ড। এই শূন্যরেখার আশ্রয়শিবিরে পাঁচ বছর ধরে বসতি করছে রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত ৬২১ পরিবারের ৪ হাজার ২০০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। স্থলযুদ্ধের পাশাপাশি আকাশ থেকে ছোড়া গোলাগুলি ও মর্টার শেল, বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় উদ্বিগ্ন শূন্যরেখার রোহিঙ্গারাও।

এই আশ্রয়শিবিরে ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান দিল মোহাম্মদ টানা ১০ বছর মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সদস্য ছিলেন। রাখাইন রাজ্যের মেদিপাড়ার বাসিন্দা দিল মোহাম্মদ (৫০) প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৩৯, ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারের বিপরীতে ‘খা মং সেক’ পাহাড়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর তুমুল যুদ্ধ ও সংঘর্ষ চলছে। বিভিন্ন পাহাড়ে সেনাবাহিনী একাধিক অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করে আরাকান আর্মির লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানছে। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ে স্থাপন করা হয়েছে সেনাবাহিনীর একাধিক অস্থায়ী ঘাঁটি। অন্যদিকে মংডুর সেনা সদর দপ্তর থেকে হেলিকপ্টার ও জেট ফাইটার এসে গুলিবর্ষণের পাশাপাশি মর্টার শেল নিক্ষেপ করছে। খা মং সেক থেকে মংডুর দূরত্ব প্রায় ২৮ কিলোমিটার। চলমান এই যুদ্ধে আরাকান আর্মির ১০-১৫ জন এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অন্তত ৭০ জনের মৃত্যুর খবর বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছড়িয়েছে।

দিল মোহাম্মদ বলেন, যুদ্ধের তীব্রতা বাড়তে থাকায় আশ্রয়শিবিরে থাকা রোহিঙ্গারাও অনিরাপদ বোধ করছে। চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। আশ্রয়শিবিরের ওপর মর্টার শেল, বোমা কিংবা গুলি এসে পড়লে হতাহতের ঘটনা বাড়বে।

এমন অবস্থায় সীমান্তের দিকে কাউকে যেতে দেওয়া হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত থেমে থেমে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলছে। চেয়ারম্যান বলেন, ২৮ আগস্ট মিয়ানমার থেকে ছোড়া দুটি মর্টার গোলা তুমব্রু বাজারের উত্তরপাড়ায় পড়ে ছিল। গোলা দুটির বিস্ফোরণ ঘটেনি। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা গোলাগুলো নিষ্ক্রিয় করেন।

তবে ওই ঘটনার পর বাংলাদেশ সীমান্তে আর কোনো গুলি কিংবা মর্টারের গোলা বাংলাদেশ ভূখণ্ডে এসে পড়েনি বলে জানিয়েছেন ঘুমধুম পুলিশ তদন্ত ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক সোহাগ রানা। তিনি বলেন, মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরেই গোলাগুলি হচ্ছে। মর্টার শেলসহ ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দ এপারের লোকজনের কানে বাজছে। কিন্তু কারা গোলাগুলি করছে, তা জানা সম্ভব হচ্ছে না।