বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার বহরবুনিয়া ইউনয়নের তিন পাশে কেওড়া, মানিক ও পানগুছি নদী। ঘূর্ণিঝড় রিমাল আঘাত হানার আগে থেকেই এখানে জোয়ারের পানি উঠতে শুরু করে। ঝড়ের রাতে পুরো ইউনিয়ন ডুবে যায়। তিন নদী থেকে উঠে আসে জলোচ্ছ্বাসের পানি। বেড়িবাঁধ না থাকায় এ অঞ্চল আজ মঙ্গলবার দুপুরের জোয়ারেও ডুবেছে আরও একবার।
সরেজমিনে দেখা যায়, ইউনিয়নের ঘষিয়াখালী, ফুলহাতা ও বহরবুনিয়া গ্রামে সবচেয়ে বেশি পানি উঠেছে। দুই দিন ধরে ডুবে থাকা বাড়িঘরে রান্না–খাওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। তার মাঝেই মানুষজন কোনোরকমে চালাচ্ছেন টিকে থাকার যুদ্ধ। পুরো এলাকা বিদ্যুৎ–বিচ্ছিন্ন প্রায় তিন দিন ধরে। ফলে অধিকাংশ মানুষের মুঠোফোনে চার্জ নেই। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় চাকরি করা অনেকেই উৎকণ্ঠা নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসছেন।
তেমনই একজন ফুলহাতা গ্রামের বাসিন্দা ইমতিয়াজ ইসলাম। চাকরিসূত্রে তিনি থাকেন ঢাকায়। আজ দুপুর সোয়া ১২টার দিকে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় রামপাল উপজেলার মল্লিকের বেড় খেয়াঘাটে। একই ট্রলারে পার হয়ে আমরা পৌঁছাই নদীর অপর প্রান্তের ঘষিয়াখালী গ্রামে। তিনি বলেন, ‘বাড়িতে বৃদ্ধা মা আছে। গতকাল সোমবার থেকে কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারছি না। শুনছি, ঝড়ে ঘর ভেঙে গেছে। বাড়িভিটা পানিতে ডুবে আছে। এখন কে যে কেমন আছে, তা–ও তো জানতে পারছিলাম না। তাই ভোরে রওনা দিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছি। এখন বাড়ি যাচ্ছি।’
এই পারের রাস্তাঘাটজুড়ে দেখা গেল ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতচিহ্ন। স্রোতের তোড়ে ভেসে গেছে রাস্তাঘাট। ঝড়ের আঘাতে উপড়ে যাওয়া গাছপালা আর বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। যাঁদের ঘর টিকে আছে, সেসব বাড়িঘরও পানিতে ডুবে আছে। অনেক ঘরের চালা-খুঁটি টিকে থাকলেও মাটির মেঝে ‘নাই’ হয়ে গেছে।
বহরবুনিয়া ইউনিয়ন, পাশের রামপাল ও মোরেলগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় বেলা একটা থেকে ভেঙে যাওয়া রাস্তা ও গ্রামীণ বাঁধ উপচে আবারও তিন দিক দিয়ে পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। ঘষিয়াখালী গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের বাসিন্দা বিউটি আক্তার বলেন, ‘আমাগো সব ডুবে গেছিল। সারা রাইত ঘরে চৌকির ওপর বসে ছিলাম। নিচের দিয়ে স্রোত গেছে। এখনো আবার পানি ঢুকতেছে। ঘরবাড়ি সব ভাইসে গেছে, দুই দিন কোনো রান্না হয় না। স্রোতে ঘরের পোতা (মেঝে), রান্নাঘর-চুলাও ভেঙে গেছে। ঘরের মধ্যেও এখন কাঁদা। বড় বিপদের মধ্যে আছি।’
ওই এলাকার তাসলিমা আক্তার বলেন, ‘আমাগো এলাকায় বাঁধ নেই। জোয়ারের পানি ঢুকলেও এমন অবস্থা হয়নি। এবার সব ভাসাই নিয়া গেছে। ঘরডা কোনো রকম দাঁড়ায় আছে, কিন্তু পোতার মাটি স্রোতের ভাসায় নিয়া গেছে। আমরা আছি, কিন্তু কীভাবে আছি, তা কইতে পারব না। ছোট বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কী যে কষ্ট, তা বলা যাবে না। পুকুরটা ভরা মাছ ছিল, সব ভাইসা গ্যাছে। আমাগে যদি বাঁধ না দেন, আমরা তালি ভাসি যাব। এই গ্রাম মনে হয় নদীতে চইলা যাবে।’
বহরবুনিয়া ইউনিয়নের কোথাও পিচের রাস্তা ছিল না। এখানে রাস্তা বলতে কেবল ইটের সলিং। তা–ও সব জায়গায় নেই। মাটির রাস্তাই বেশি। স্থানীয় তোরাব মেমোরিয়াল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সাজিদ শেখ বলেন, ‘স্রোতে সব রাস্তা ভাইসে গেছে। এ গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়ার রাস্তাগুলো ভেসে যাওয়ায় চলাচলে খুবই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।’ ফুলহাতা গ্রামের ষাটোর্ধ্ব হারুণ শেখ বলেন, ‘৫ মিনিটের পথ যাইতে এখন লাগতেছে আধা ঘণ্টা। সব ধুয়ে গেছে। গর্ত-পানি পার হয়ে চলতে হচ্ছে।’
ওই গ্রাম থেকে ফেরার পথে দেখা হলো আরও কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা উৎকণ্ঠা নিয়ে ফিরছেন গ্রামের বাড়িতে। তেমন একজন ফুলহাতা গ্রামের মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি থাকি ঢাকায়। ঝড়ের পর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। পাশের বাড়ি কথা বলে শুনছি, থাকার ঘরডা আছে, কিন্তু আশপাশের সব গেছে ভাইঙ্গে। তাই বাড়ি যাচ্ছি। এই এলাকাই মনে হয় ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হইছে।’