ছোট্ট ছাউনির ভেতরে ঘুমাচ্ছেন একদল বিএনপি নেতা–কর্মী। বাইরে পাহাড়ায় আরেক দল। গত ১৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের সায়েদাবাদ চরে
ছোট্ট ছাউনির ভেতরে ঘুমাচ্ছেন একদল বিএনপি নেতা–কর্মী। বাইরে পাহাড়ায় আরেক দল। গত ১৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের সায়েদাবাদ চরে

গ্রেপ্তার এড়িয়ে যেভাবে রাত কাটান নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতা-কর্মীরা

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার নাগরহাটি খেয়াঘাট থেকে মেঘনা পাড়ি দিয়ে আড়াইহাজারের সায়েদাবাদ চর। ডিঙিনৌকায় সময় লাগে মিনিট দশেক। ‘চরে সাপ, শিয়ালের ভয় আছে’—ঘাটে নামার আগে সাবধান করে দেন মাঝি সোহরাব আলী। নৌকা থেকে নেমে কিছুদূর হাঁটার পর কাশবন ও গাছে ঘেরা একটি ছাউনি। বিএনপির কয়েকজন নেতা-কর্মী আশ্রয় নিয়েছেন সেখানে।

সায়েদাবাদের চরে দল বেঁধে আশ্রয় নেওয়া সবাই সোনারগাঁর বারদী ইউনিয়ন বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপির নেতা-কর্মীরা এভাবে বাড়ি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা দল বেঁধে ফসলি জমি, নদীর চর ও জঙ্গল, এমনকি কবরস্থানেও আত্মগোপন করছেন। কেউ কেউ থাকছেন মাঝনদীতে ভাসমান নৌকায়।

এর পরও গ্রেপ্তার এড়াতে পারেন না অনেকে। পুলিশের হিসাব বলছে, গত চার সপ্তাহে নতুন করে জেলার সাতটি থানায় হওয়া ২০টি মামলায় পাঁচ শতাধিক বিএনপির নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন।

‘কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না’

সায়েদাবাদের চরে আশ্রয় নেওয়া দলটির নেতৃত্বে আছেন উপজেলা মৎস্যজীবী দলের আহ্বায়ক সেলিম হোসেন ওরফে দিপু। আগে থেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে ১৭ নভেম্বর রাতে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, লম্বা কাশবন আর গাছে ঘেরা একটি স্থানে ৪ ফুট উচ্চতার ৮০ বর্গফুটের ছোট্ট ছাউনি। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে বাঁশের ছাউনির ওপর পলিথিন দেওয়া। সাপ-পোকা থেকে রক্ষা পেতে ছাউনি ঢাকা হয়েছে মশারির মতো ঘন জালে। ভেতরে খড়ের ওপর বিছানা পাতা। এর মধ্যেই ছয়জন ঘুমাচ্ছেন। বাইরে পায়চারি করতে করতে পাহারায় আছেন চারজন। এই ১০ জনের মধ্যে ছয়জনের নামেই একাধিক মামলা রয়েছে। বাকি চারজন ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানালেন।

গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে একটি আশ্রয়ের জায়গা কমবে, এ শঙ্কায় প্রথমে জায়গাটি দেখাতে রাজি ছিলেন না সেলিম হোসেন। একপর্যায়ে তিনি রাজি হন। তবে শর্ত দেন, সঙ্গে মুঠোফোন নেওয়া যাবে না। কারণ হিসেবে সেলিম বলেন, এখন আর কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না।

পাহারায় থাকা নেতা-কর্মীরা জানান, গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁরা প্রায় এক মাস বাড়িছাড়া। সায়েদাবাদের এ ছাউনিটি তাঁদের পরিচিত এক বিএনপির সমর্থক জেলের। তাঁরা গত দুদিন রাতে ছাউনিটিতে থাকছেন। এলাকার মানুষ টের পাওয়ার আগেই আবার মেঘনা পাড়ি দিয়ে সোনারগাঁ চলে যান।

নিভে যাওয়া কয়েলে আগুন দিতে দিতে সেলিম হোসেন বলেন, তার আগে টানা চার রাত তাঁরা মেঘনা নদীতে জেলে নৌকায় কাটিয়েছেন। তারও আগে কবরস্থান, লিচু বাগান ও বিলের পাড়ে থেকেছেন। আবার কখনো মেঘনা পাড়ি দিয়ে কুমিল্লায় গিয়ে থেকেছেন। গত ১৭ অক্টোবর উপজেলাজুড়ে ধরপাকড় শুরু হলে প্রথমে তাঁরা বাড়ি থেকে পালিয়ে বিভিন্ন সমর্থক ও স্বজনের বাড়িতে যান। পুলিশ অভিযান চালিয়ে স্বজনদেরও ধরতে থাকে। বাধ্য হয়ে তখন নিরাপত্তার জন্য ফেরারি জীবন বেছে নেন তাঁরা।

গত ২৮ অক্টোবরের আগে থেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন নারায়ণগঞ্জ বিএনপির অনেক নেতা-কর্মী। গত ১৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের সায়েদাবাদ চরে

নানা কৌশলে পালিয়ে থাকা

আলাপে জানা গেল, নিজেদের পুরোনো স্মার্টফোন ও নম্বর বদলে ফেলেছেন এই নেতা-কর্মীরা। প্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশ যেন তাঁদের খোঁজ না পায়, সে জন্যই এমন ব্যবস্থা। মুঠোফোন নম্বর বদল ছাড়াও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য রাতে দুটি দলে ভাগ হন আত্মগোপনে থাকা নেতা-কর্মীরা। একদল পাহারা দিলে আরেক দল বিশ্রাম নেয়। এর বাইরে এলাকায় যাঁরা বিএনপির সমর্থক আছেন, তাঁদেরও সতর্ক থাকতে বলা হয়। এলাকায় অপরিচিত কোনো লোক দেখলেই খবর জানানো হয়।

নিজেদের এমন জীবন নিয়ে ধৈর্যহারা হয়ে পড়ছেন বলে জানালেন ছাউনির আরেক বাসিন্দা বিল্লাল হোসেন। বারদী ইউনিয়ন শ্রমিক দলের সভাপতি তিনি। বিষণ্ন কণ্ঠে বিল্লাল বলেন, ‘আমরা অসহায় অবস্থায় আছি। সকালবেলা পুলিশ এলে, বিকেলে ডিবি। রাইতে আসে আওয়ামী লীগের লোকজন। আমরা কেউ বাড়িঘরে থাকতে পারি না। সবার বাড়ি পুরুষশূন্য। মনে হয় মৃত্যু ছাড়া এই জুলুম থেইকা বাঁচার উপায় নাই।’

ভালো নেই স্বজনেরাও

ছাউনির পাশে কথা বলার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রফিকুল ইসলামের। বারদী ৪ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক তিনি। তাঁর ভাই আলী আসগর ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান। রফিকুল জানান, বড় ভাই আলী আসগর ও নিজের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে তাঁর স্বজনেরা ভুক্তভোগী। তাঁরা দুই ভাই বাড়ি থেকে পালিয়ে গ্রেপ্তার এড়াতে পারলেও পুলিশ তাঁর অপর দুই ভাই সফর আলী (৬৫), আনোয়ারুল ইসলাম (৬০) ও ভাতিজা জিয়াউলকে গ্রেপ্তার করেছে। প্রায় ১৫ দিন তাঁরা কারাবন্দী।

রফিকুল বলেন, নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেওয়া ছাড়া তাঁর ভাই ও ভাতিজার অন্য কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই। এমনকি তাঁদের বিরুদ্ধে কখনো কোনো মামলাও হয়নি। ‘পুরোনো গায়েবি মামলায়’ অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় তাঁদের। রফিকুল বলেন, বিএনপি নেতা-কর্মীদের স্বজনেরাও এখন ভালো নেই। পুরুষ স্বজনেরা রাজনীতি না করেও গ্রেপ্তার আতঙ্কে বাড়িছাড়া আর পুরুষশূন্য ঘরগুলোতে অর্থাভাবসহ নানা সংকটে পড়েছেন নারী সদস্যরা।

হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ

সোনারগাঁ উপজেলার এই নেতা-কর্মীদের মতো জেলার অনেক বিএনপির নেতা-কর্মী ফেরারি জীবন কাটাচ্ছেন। জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি সফিকুল ইসলামও তেমনি একজন। ২২ অক্টোবর থেকে অনুসারীদের নিয়ে কিছুদিন জেলার বাইরে থাকার পর ৩ নভেম্বর এলাকায় ফেরেন তিনি। তার পর থেকে ভুলতা ৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেনের নেতৃত্বে অন্তত ৩০ জন পাড়াগাঁও কবরস্থানে রাত কাটাতে শুরু করেন। ১৩ নভেম্বর রাতে ক্ষমতাসীন দলের একদল সমর্থক সেখানে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালিয়ে ছাউনি, কাঁথা, বালিশ সব পুড়িয়ে দেয়।

গত বুধবার বিকেলে মুঠোফোনে সফিকুল ইসলাম বলেন, এখনো তাঁরা ১১ জন ঢাকার একটি স্থানে আত্মগোপনে আছেন। দীর্ঘদিন ফেরারি থাকতে গিয়ে উপার্জনের পথ বন্ধ হয়েছে। এখন তাঁর পরিবারের লোকজন অভাব–অনটনে দিন কাটাচ্ছেন। কেবল ভুলতা ইউনিয়নেরই দুই শতাধিক যুবদল নেতা-কর্মী বাড়িছাড়া বলে দাবি সফিকুলের।
পালিয়ে থাকা বিএনপির নেতা–কর্মীদের বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত চার সপ্তাহে জেলার অন্তত ৬৩ নেতা-কর্মীর বাড়িঘরে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। কিছু ঘটনায় বাড়ির নারী সদস্যদের মারধর করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতা–কর্মীরা এসব হামলা চালিয়েছেন বলে বিএনপির অভিযোগ।

পালিয়ে বেড়ানো বিএনপির এই নেতা-কর্মীরা মনে করেন, বিএনপি আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবে। তখন আর তাঁদের পালিয়ে বেড়াতে হবে না। রাজনৈতিক মামলাগুলো থেকেও তাঁরা রেহাই পাবেন।

সেলিম, বিল্লাল, রফিকুলদের গল্প শুনতে শুনতে রাত দুইটা বেজে যায়। বৃষ্টির তোড় বাড়ায় সবাই ছাউনিতে আশ্রয় নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বৃষ্টি কমলে সেলিমদের ছাউনি পেছনে ফেলে আবারও আমাদের ডিঙি ভাসে। সেলিম হোসেনরা তখনো সেখানেই আছেন। তাঁদের ক্লান্ত চোখে তখন ভোর হওয়ার অপেক্ষা। কারণ, লোকজন টের পাওয়ার আগেই ছাড়তে হবে চর।