মহাষষ্ঠীতে প্রতিমার আসনে প্রতিমা স্থাপন থেকে দশমীতে বিসর্জন—শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতার সবখানেই ঢাকের বাজনা চাই-ই চাই। এরই মধ্যে মন্দিরসজ্জায় ব্যস্ত সময় পার করছেন পূজারিরা। দুর্গাপূজার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢাকের চাহিদা মেটাতে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায় প্রতিবছরের মতো এবারও বসেছে ঢাকের হাট। এই হাটে পর্যাপ্ত ঢাকি থাকলেও ঢাকির দলকে বায়না করতে আসা পূজারির সংখ্যা কম।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে এই ঢাকির হাটের ঐতিহ্য ৪০০ বছরের বেশি সময়ের। মণ্ডপে বাদ্য বাজানোর জন্য দর-কষাকষির মাধ্যমে পূজারিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া হাটের রীতি। আগের দুই বছরের চেয়ে এবার হাটে ঢাকি দলের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে বাড়েনি বায়না দিতে আসা পূজারির সংখ্যা। চুক্তিতে প্রত্যাশিত অর্থ না পেয়ে মন ভালো নেই ঢাকিদের।
একটি ঢাকি দলের প্রধান শ্যামল চন্দ্র সাহা এসেছেন নরসিংদীর মাধবদী থেকে। তাঁর দলে সদস্যসংখ্যা ১২। তাঁদের মধ্যে বাঁশিবাদক তিনজন, ঢোলে আছেন দুজন। বাকিরা কাঁসর, সানাই, করতাল ও খঞ্জরিবাদক। গত বুধবার বিকেল থেকে দলটি হাটে অবস্থান করছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ৪৫ হাজার টাকায় দলটির বায়না হয় ময়নসিংহের একটি পূজামণ্ডপে।
শ্যামল চন্দ্র বলেন, ‘৬০ হাজার টাকা আশা করছিলাম। দরদাম করছে কম। শেষে বায়না মিস হয়ে যায় কি না, এই ভয়ে ৪৫ হাজার টাকায় চুক্তিবদ্ধ হইয়া গেলাম।’ তাঁর মতে, এই বছর ঢাকি দলের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে সেই তুলনায় পূজারির সংখ্যা কম। সেই কারণেই কম দামে চুক্তিবদ্ধ হতে হচ্ছে।
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তাঁর রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা ঢাকিদের সন্ধান করতে বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান। সে সময় নৌপথে অসংখ্য ঢাকি দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হয়। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নেন এবং পুরস্কৃত করেন।
সেই থেকেই যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু। পরবর্তী সময়ে হাট স্থানান্তরিত হয় পুরানবাজারে। এখনো হাট বসে সেখানে। নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, হবিগঞ্জ থেকে হাটে ঢাক দল আসে বেশি। শুরুর রীতি অনুযায়ী এখনো হাটে ঢাকিরা পূজারির দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য সমবেতভাবে বাজনা বাজান। বাজনায় যে দলের যত মুনশিয়ানা, পূজারির কাছে কদর তত বেশি। এবার হাট বসেছে বুধবার থেকে। আজ শুক্রবার হাটের শেষ দিন। মূলত দুপুরের পর থেকে হাট ভাঙতে শুরু করেছে।
ঢাকির হাটের আয়োজকদের ভাষ্য, কয়েক বছর ধরে কটিয়াদীর ঢাকের হাট ঐতিহ্য ও জৌলুস হারাচ্ছে। প্রতিবছর মণ্ডপ বাড়লেও হাটে ঢাকিদের অংশগ্রহণ, চাহিদা ও কদর—সবই কমছে। প্রযুক্তির উৎকর্ষ হাটের ঐতিহ্যে বড় আঘাত হেনেছে। বিশেষ করে মুঠোফোন সবার জন্য সহজলভ্য হয়ে ওঠার পর আঘাতটি আরও বেড়ে যায়। এখন পূজারিরা আর হাটে এসে দরদাম করে ঢাক দল নির্বাচন করতে আগ্রহী নন। আগেই দলপ্রধানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ হয়ে যায়। মুঠোফোনেই দরদাম করে চুক্তিবদ্ধ হয়। আর বায়না আসে বিকাশে। এ কারণে প্রতিবছর হাটের কদর ও জৌলুস—দুই কমছে।
পূজারি বিমল চন্দ্র দাস এসেছেন ময়মনসিংহের গৌরীপুর থেকে। বাজনার মুনশিয়ানা দেখে মণ্ডপের জন্য পছন্দসই ঢাক দল নিয়ে যাবেন, এই ভাবনায় হাটে আসা তাঁর। বিমল চন্দ্র বলেন, ‘চাইলেই ফোনে কোনো না কোনো দলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পারতাম। ফোনে চুক্তিবদ্ধ হলে কষ্ট কম হতো, সময় বেঁচে যেত। তবে জেনেশুনেই কষ্টটা মেনে নিয়েছি। কারণ, হাটে এলে দুর্গাপূজার অনুভুতিটা পুরোপুরি উপভোগ করা যায়।’
আজ দুপুর ১২টা পর্যন্ত অনেক ঢাক দলই বায়নার অপেক্ষায় ছিল। হবিগঞ্জের আজমিরিগঞ্জ থেকে আসা একটি ঢাক দলের প্রধান গণেশ চন্দ্র। পাঁচ বছর ধরে তিনি এ হাটে আসেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরাও হাটে আসতেন। ১৩ জনের দল তাঁর। চুক্তিবদ্ধ হতে না পেরে হতাশ হয়ে গণেশ বলেন, হাটের প্রতি একধরনের মায়া কাজ করে। ঝুঁকি থাকলেও মায়ার টানেই প্রতিবছর আসেন। ১৩ সদস্যের দলের জন্য অন্তত ৮০ হাজার টাকা না হলে পোষাবে না। অথচ ৫০ হাজার টাকার ওপরে কেউ বলছেন না। আর এখন তো দরদাম করার লোকই নেই।
কটিয়াদী পূজা উদ্যাপন পরিষদের আহ্বায়ক শিবু প্রসাদ বণিক। ঢাকির হাট নিয়ে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। হাটের বর্তমান চিত্রে হতাশ শিবু প্রসাদ বলেন, সারা দেশে এটি একমাত্র ঢাকের হাট। একসময় ঢাক ও ঢাকি পেতে কয়েক জেলার মানুষের কাছে কটিয়াদীর হাটের বিকল্প ছিল না। ঢাকের বাজনায় কয়েক দিন মুখর থাকত চারপাশ। তিন থেকে চার শ ঢাকি চুক্তিবদ্ধ হতেন হাট থেকে। এবার দলের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। দেড় শতাধিক ঢাক দল চুক্তিবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে।
গতকাল হাট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. অহিদুজ্জামান। ঘুরে এসে তিনি বলেন, ঢাকিদের সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে।