কক্সবাজারের উখিয়ায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে প্রায়ই গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে। সংঘর্ষে জড়াচ্ছে মিয়ানমারের একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী। ঘর থেকে তুলে নিয়ে গুলি কিংবা কুপিয়ে হত্যার ঘটনাও রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রোহিঙ্গা বসতিতে নাশকতার আগুন। এই সবকিছুর মূলে এক ব্যক্তিকে দায়ী করছেন সাধারণ রোহিঙ্গা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তিনি হলেন নবী হোসেন (৪৮)।
রোহিঙ্গা নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যমতে, নবীর হাত ধরেই ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথের (আইস) বড় বড় চালান ঢুকছে উখিয়া ও টেকনাফে। আশ্রয়শিবিরগুলোয় প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ৬০০ কোটি টাকার ইয়াবা ও আইস ঢুকছে। ৯০ শতাংশ ইয়াবার কারবার নবী হোসেন বাহিনীর কবজায়। নবী হোসেনের এই কারবারে সহযোগিতা দেয় মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) আরও ৯টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী। বিনিময়ে তারা পায় মাদক বিক্রির টাকার ভাগ।
গত পাঁচ বছরে র্যাব, বিজিবি, পুলিশ, এপিবিএনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অন্তত অর্ধশতাধিক অভিযান চালিয়েও নবী হোসেন ও তাঁর অন্যতম সহযোগী আবদুল হাকিমকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। তবে একাধিক বন্দুকযুদ্ধে তাঁদের বাহিনীর অন্তত ১৪ জন নিহত হয়েছেন। গত বছরের মার্চ মাসে নবী হোসেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিলে ১০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করে বিজিবি।
সোমবার উখিয়ার বালুখালীসহ কয়েকটি আশ্রয়শিবিরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, মাদকের টাকার ভাগাভাগি এবং আশ্রয়শিবিরে অধিপত্য বিস্তার ঘিরে চার থেকে পাঁচ মাস ধরে নবী হোসেন বাহিনীর সঙ্গে মিয়ানমারের সশস্ত্রগোষ্টী আরাকান স্যালভেশন আর্মির (আরসা) মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ হয়েছে। আরসাকে ঠেকাতে নবী হোসেন বাহিনীর পক্ষ হয়ে মাঠে নেমেছে আরএসও।
২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আরসা সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ। হত্যাকাণ্ডের পর আরসার সঙ্গে নবী হোসেনের বিরোধ দেখা দেয়। তখন আরসার হামলা ও গুলিতে নবী হোসেন বাহিনীর কয়েকজন নিহত হন। আরসাকে ঠেকাতে নবী হোসেন হাত মেলান আরএসওর সঙ্গে।
কে এই নবী হোসেন
২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নিপীড়নের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় আট লাখ রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গা ঢলের সঙ্গে আসেন নবী হোসেনও। তাঁর বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের ঢেকুবনিয়ায়। বাবার নাম মোস্তাক আহমদ। তাঁর ঠাঁই হয় উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) বি-ব্লকের ৪১ নম্বর শেডে। ২০১৮ সালের শুরুতে মিয়ানমার থেকে আশ্রয়শিবিরে এবং টেকনাফে ইয়াবার বড় চালান আনা শুরু করেন নবী হোসেন। তখন টেকনাফের একজন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন নবী। আশ্রয়শিবিরে নিজের নামে গড়ে তোলেন ‘নবী হোসেন’ বাহিনী। এই বাহিনীর সদস্য তিন শতাধিক।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, নবী হোসেনের এক ভাই ভুলু ক্যাম্প-৮ পশ্চিমের ডি ব্লক এবং আরেক ভাই মোহাম্মদ কামাল বি-৪১ ব্লকের মাঝির দায়িত্বে ছিলেন, আরসার হুমকিতে এখন তাঁরা আত্মগোপনে। বালুখালী এলাকার চারটি আশ্রয়শিবির (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম, ৯, ১০ ও ১৪) নবী হোসেন বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। টাকার ভাগ বসিয়ে মাদক চোরাচালানে নবী হোসেনকে সহযোগিতা দেয় আরও ৯টি রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বাহিনী। এদের মধ্যে রয়েছে মাস্টার মুন্না, ইসলাম, আবদুল হাকিম, আসাদ, জুবাইর, জাবু, মুমিন, জাকির ও শফিউল্লাহ বাহিনী।
নবী হোসেন আশ্রয়শিবিরে নেই। মিয়ানমারসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান করে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন।ফারুক আহমেদ, সহকারী পুলিশ সুপার, ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন
১০ লাখ টাকার পুরস্কার ঘোষণাও কাজে লাগেনি
২০২২ সালে মার্চে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরসহ উখিয়া ও টেকনাফে নবী হোসেনকে জীবিত অথবা মৃত ধরে দিতে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে পোস্টার সেঁটেছিল বিজিবি কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়ন। পোস্টারে জঙ্গলের ভেতরে অস্ত্র হাতে দাঁড়ানো নবী হোসেনের ছবি ছাপানো হয়। এতে লেখা হয়, ‘ইয়াবা গডফাদার ও মিয়ানমারের নাগরিক নবী হোসেনকে জীবত অথবা মৃত ধরে দিতে পারলে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার প্রদান করা হবে।’ পোস্টারটি এখনো সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে দেখা যায়। এখন পর্যন্ত নবী হোসেনের বিষয়ে কেউ সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেননি।
আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ৮ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া ও অপারেশন) ফারুক আহমেদ বলেন, নবী হোসেন আশ্রয়শিবিরে নেই। মিয়ানমারসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান করে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করছেন। ইতিমধ্যে এই বাহিনীর কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
পুলিশ জানায়, গত ৬ জানুয়ারি বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) আরসা সন্ত্রাসীদের হামলায় গুলিবিদ্ধ হন নবী হোসেন বাহিনীর মোহাম্মদ নবী (৪০)। ওই দিন বিকেলে এপিবিএন সদস্যরা গুলিবিদ্ধ নবীর ঘরে তল্লাশি চালিয়ে অত্যাধুনিক একটি গ্রেনেড উদ্ধার করে। গ্রেনেড উদ্ধারের ঘটনায় ৮ জানুয়ারি উখিয়া থানার নবী হোসেনকে প্রধান আসামি করে ৩৪ জনের নামে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করে এপিবিএন।
মামলায় নবী হোসেনের ঠিকানা দেখানো হয় বালুখালী আশ্রয়শিবিরের (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) বি-৪১ ব্লকে। একই মামলায় ৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহ আবু আম্মার জুনুনিকে। এজাহারে জুনুনির ঠিকানা লেখা হয় বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু কোনারপাড়া সীমান্তে শূন্যরেখায়।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, গত সাড়ে চার মাসে উখিয়ার আশ্রয়শিবিরে একাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। নিহত হয়েছেন অন্তত ২৩ জন রোহিঙ্গা। এর মধ্যে তিনটি হত্যা মামলায় নবী হোসেন এবং চারটি মামলায় আরসার প্রধান কমান্ডার আতাউল্লাহকে আসামি করা হয়েছে। নানাভাবে চেষ্টা করেও দুই সন্ত্রাসীকে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
আস্তানা মিজ্জির পাহাড়
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, মাঝেমধ্যে নবী হোসেন আশ্রয়শিবিরে ঢুকে বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে গোপন বৈঠক করে টেকনাফের দুর্গম মিজ্জির পাহাড়ের আস্তানায় রাত কাটান। নবী হোসেন বাহিনীর কাছে একে-২২ রাইফেলসহ অন্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ রয়েছে। নবী হোসেনকে সহায়তা করে ৯টি রোহিঙ্গা ডাকাত বাহিনী। এর মধ্যে বেশি টাকার ভাগ পায় আবদুল হাকিম বাহিনী। হাকিমের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় হত্যা, ধর্ষণ, অস্ত্র, মাদকসহ ২১টি মামলা রয়েছে।
পুলিশ জানায়, ২০১৬ সালের ১৩ মে টেকনাফের শালবন আশ্রয়শিবিরের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালায় হাকিম বাহিনী। ওই সময় আনসার কমান্ডার আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যার পর লুট করা হয় ১১টি রাইফেল।