ব্রহ্মপুত্র নদের পারের ময়মনসিংহ শহরে এখন প্রার্থীদের ভোটের প্রচার, গণসংযোগ নজর কাড়ে। দু-একজন প্রার্থীকে নিয়ে কৌতূহলও আছে অনেকের। কিন্তু শহর ছেড়ে বাইরে গেলে চিত্র অনেকটাই ভিন্ন, যেন নদীর একূল আর ওকূল। ভোট নিয়ে খুব একটা উৎসাহ-আগ্রহ নেই সাধারণ মানুষের। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, প্রায় একই চিত্র জেলার অন্য ১০টি আসনেও।
কেন এমন চিত্র? ময়মনসিংহ শহরের অদূরে চর বড়বিলার বাসিন্দা কৃষক আকরাম আলীর ভাষ্য, ‘তারা তারা ভোট করছে। যারা পার্টি করে হেরা হয়তো আছে, আর সব তো চ্যাংড়া পোলাপান।’
আকরাম আলীর সঙ্গে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কথা হয় ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের কাছারিঘাটের ওপারে। তিনি শহরে যাচ্ছিলেন। অপেক্ষায় আছেন খেয়াতরির ঘাটে। তাঁর মতে, ভোট হচ্ছে আওয়ামী লীগ-আওয়ামী লীগ। ভোট নিয়ে সবার মধ্যে আগ্রহ নেই।
বিষয়টি স্বীকার করেন ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য কাজী আজাদ জাহানও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এটা সত্য যে বিএনপি ভোটে না থাকায় একটি বড় অংশ নির্বাচনে আগ্রহী নয়।
ময়মনসিংহ জেলায় ১১টি সংসদীয় আসন। ৯টিতে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আছে। এর মধ্যে দুটি আসন ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) ও ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আওয়ামী লীগ সমঝোতার মাধ্যমে জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রার্থী যথাক্রমে সালাহউদ্দিন আহেমদ ও ফখরুল ইমামকে ছেড়ে দিয়েছে। যদিও কোনোটিতেই জাপার প্রার্থীরা মজবুত অবস্থানে নেই।
তবে ১১টি আসনের মধ্যে ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসন ছাড়া বাকি ১০টিতেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এর মধ্যে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল হক ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট ও ধোবাউড়া), আবদুল মালেক সরকার ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) ও মাহমুদ হাসান ময়মনসিংহ-৮ এবং এ বি এম আনিছুজ্জামান পৌর মেয়র থেকে পদত্যাগ করে ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনে নৌকার প্রতীকের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
স্থানীয় রাজনীতিক এবং জেলার নির্বাচন পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছেন, এমন পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, অধিকাংশ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের অবস্থা ভালো নয়।
ময়মনসিংহ জেলা জাপার সদস্যসচিব মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে যে তথ্য, তাতে জেলার ১১টি আসনের মধ্যে ৭–৮টিতে স্বতন্ত্ররা এগিয়ে আছে, এটা তো আওয়ামী লীগের জন্য ভালো খবর নয়। এটা কীভাবে সামলাবে তারা।’
মোশাররফ জানান, এ রকম একটা অবস্থায় কয়েকটি আসনের ///////স্বতন্ত্র প্রার্থীর পিছিয়ে দিতে নৌকার পক্ষে কাজ করতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের বিভিন্ন স্থান থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে তাঁরা খবর পাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নৌকা প্রতীক এবং আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীর লড়াই পরিস্থিতি সদর আসনেও (ময়মনসিংহ-৪)। এই আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী সাবেক ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমানের ছেলে মোহাম্মদ মোহিত উর রহমান (শান্ত)। আসনটিতে ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও ধনাঢ্য ব্যক্তি আমিনুল হক (শামীম)। তিনি গণসংযোগে, প্রচারে—এমনকি দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভাগাভাগিতেও সুস্পষ্ট ব্যবধান তৈরি করে নৌকার প্রার্থীর জন্য অস্বস্তি সৃষ্টি করেছেন বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।
এই আসনে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম নৌকার পক্ষে থাকলেও সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন ট্রাক প্রতীকের পক্ষ নিয়েছেন। এভাবে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতারা দলীয় প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে-বিপক্ষে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। এই আসনে রওশন এরশাদ নির্বাচন করতেন।
যদিও এই বিভক্তি ক্ষণিকের এবং কৃত্রিম বলছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা। কারণ, এই নির্বাচনে মূল বিরোধী দল বিএনপি নেই। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলও নির্বাচনে নেই। এই ভোটে সরকারের কোনো পরিবর্তন হবে না। নির্বাচনে যেই জিতুক, তিনি আওয়ামী লীগের।
একটা নির্বাচন ঘিরে সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ থাকে, সেটি এই নির্বাচনে নেই বলে মনে করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিশেষ পিপি শেখ আবুল হাশেম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনটা হচ্ছে এক বাপের দুই ছেলের মধ্যে। যেই পাস করুক, সমস্যা নেই।’
বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করে জানান চর বড়বিলা দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক আবদুল জলিল আকন্দ। তাঁর মতে, নৌকা পাস করলেও আওয়ামী লীগ, ট্রাক পাস করলেও আওয়ামী লীগ।
বিএনপিসহ ৬৩টি (নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত) রাজনৈতিক দল ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা এই নির্বাচন বর্জনের পক্ষে জনমত তৈরি করতে এখন সারা দেশে গণসংযোগ ও প্রচারপত্র বিতরণ করছে। অন্য দিকে আওয়ামী লীগসহ ২৮টি দল নির্বাচন করছে। কার্যত এখন মাঠে লড়াই চলছে ভোট বর্জনে এবং কেন্দ্রে ভোটার আনার।
তবে বিএনপি প্রকাশ্যে এই কর্মসূচি করতে পারছে না বলে জানান ময়মনসিংহ মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এম এ হান্নান খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রচারপত্র বিতরণ করছি অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং রাশিয়ার কেজিবির মতো গোপনীয়তা অবলম্বন করে। খবর পেলেই পুলিশ দৌড়াচ্ছে, ধরে নিয়ে যাচ্ছে। নেতা-কর্মীরা বাড়িঘরেও থাকতে পারছে না।’
এমন প্রেক্ষাপটে ময়মনসিংহে ভোটের চিত্র কেমন হতে পারে, জানতে চাইলে এম এ হান্নান খান বলেন, ‘রাজনীতিতে এখন আর আগাম কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু গায়েবি মামলা হচ্ছে একের পর এক। দেখবেন, কেন্দ্রে ভোটার যায়নি, কিন্তু ভোট দেখানো হবে ৩০-৪০ শতাংশ।’
ময়মনসিংহ সদর আসনে সংসদ সদস্য পদে প্রার্থী ১০ জন। গতকাল সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ময়মনসিংহ শহর ঘুরে মূলত নৌকা প্রতীকের মোহিত উর রহমান, ট্রাক প্রতীকের আমিনুল হক, কাঁচি প্রতীকের দেলোয়ার হোসেন খান ও লাঙ্গল প্রতীকের আবু মো. মুসা সরকার—চারজনের প্রচার চোখে পড়ে। এর মধ্যে নৌকা ও ট্রাক প্রতীকের প্রার্থীর সমর্থকদের আচরণবিধি ভঙ্গ করে প্রচার চালাতে দেখা যায়। শহরের প্রতিটি ওয়ার্ডে এই দুই প্রার্থী ৮-১০টি করে নির্বাচনী ক্যাম্প করেছেন। পোস্টারে-ব্যানারে পুরো শহর ছেয়ে ফেলেছেন। মোহিত উর রহমান নগরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে বৈদ্যুতিক বাতি দিয়ে নৌকা বানিয়ে টাঙিয়েছেন, যা সবার দৃষ্টিতে পড়ছে। কিন্তু এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তা ও প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ নেই।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আলোকসজ্জা ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গত রাতে শহরের ৩৩টি ওয়ার্ডে নৌকা, ট্রাক, লাঙ্গল, কাঁচির প্রার্থীর সমর্থকদের মিছিলের পর মিছিল বের করতে দেখা যায়। যার বেশির ভাগই তরুণ ও যুবক শ্রেণির।
এ বিষয়ে জেলা জাপার সদস্যসচিব মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘এটা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগির নির্বাচন, তবু এত হইহুল্লোড় কেন? কালোটাকা। গত ১৫ বছরে রাজনীতির ছদ্মাবরণে অনেকে ব্যাপকভাবে কালোটাকার মালিক হয়েছে। এটা অসৎ উপায়ে অর্জিত সেই টাকার দাপট। সাধারণ মানুষ, যারা একটু সচেতন, তারা এটাকে নির্বাচন বলছে না।