প্রকৃতিতে এখন বসন্ত চলছে। মাঝেমধ্যেই উড়নচণ্ডী হাওয়া বইছে। গাছের পাতায়, ঘাসে ধুলার স্তর জমছে। বসন্ত তো এ রকমই হওয়ার কথা। তবু অতটা ধুলা চোখে পড়ছে না। এরই মধ্যে কয়েক দফা বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টিতে ধুয়েমুছে গেছে ধুলাবালু। চকচকে সবুজে ঝলমল করছে গাছের পাতারা। ডালে ডালে নতুন পাতা গজিয়েছে। যেদিকে চোখ যায়, কচি পাতার রূপ-লাবণ্য এখন চারপাশে। এসব পাতার সৌন্দর্যকে আরও উজ্জ্বল করে, চোখে রঙের মায়া ছড়িয়ে মৌলভীবাজার শহরের বিভিন্ন স্থানে, আনাচে-কানাচে ফুটছে নানা জাতের ফুল। এসব ফুলের মধ্যে রয়েছে হাওরের বরুণ; আছে নাগেশ্বর, টেকোমাসহ আদরে-অনাদরে বেড়ে ওঠা চেনা-অচেনা অনেক ফুল। ফুলগুলো মুগ্ধ করছে পথচারী ও ফুলপ্রেমীদের।
জলাভূমির কাছেই বরুণ ফুলের আবাস। এই গাছের সবচেয়ে পছন্দের আবাস হচ্ছে জলাভূমি এলাকা। হাওর-বাঁওড়, নদ-নদীর পাড়ই তার প্রিয় ভূমি। ফুলটির পোশাকি নাম বরুণ হলেও এই উদ্ভিদটির আরও অনেক নাম আছে। বৈন্যা, শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম, হয়তো স্থানভেদে থাকতে পারে আরও কোনো নাম। প্রচলিত ইংরেজি নাম হচ্ছে স্পাইডার ট্রি, টেম্পল প্লান্ট ও গার্লিক পিয়ার। বৈজ্ঞানিক নাম ক্রেটেয়েভা নুরভালা—Crataeva nurvala।
বসন্তের মাঝামাঝি সময় থেকে বরুণগাছে ফুল আসতে থাকে। ফুলে ফুলে গাছ সেজে ওঠে। মাসজুড়ে গাছে ফুলের বন্যা থাকে। সাদা-হালকা বেগুনি আঁচযুক্ত ফুল ফোটে। ফুল ঝরে যাওয়ার পরপরই গাছে ফল আসে। ফল দেখতে অনেকটা কতবেলের মতো।
হাওর, হাওরপাড়ের এই ফুলের গাছ মৌলভীবাজার শহরে অন্তত তিনটি স্থানে দেখা গেছে। গাছ এখন ফুলে ভরা। এর একটি মৌলভীবাজার শহরের পূর্ব গির্জাপাড়া (ফাটাবিল) এলাকার একটি বাড়ির সীমানা ছুঁয়ে। অন্য গাছের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে বরুণগাছটি। গতকাল শুক্রবার সকালে দেখা গেছে, গাছটি থেকে যেন রাশি রাশি নির্মল হাসি ঝরছে। অন্য গাছটি শহরের এম সাইফুর রহমান সড়কের (পুরোনো সেন্ট্রাল রোড) পুরোনো থানার কাছে। এই গাছ বেশ পুরোনো, অনেক উঁচু। অপর গাছটি শহরের সৈয়ারপুর এলাকার ভৈরব থলির কাছে নিচু এলাকায়। মনু নদের তীরঘেঁষা খালি জায়গায় বেশ বড়সড় ঝাঁকালো আকারের গাছটি দাঁড়িয়ে আছে। সারা গাছ ফুলে ফুলে ভরে আছে।
মৌলভীবাজার শহরের কোর্ট রোডের সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে ফুটপাত ঘেঁষে একটি গাছে ফুটেছে অসংখ্য নাগেশ্বরের ফুল। শাখা-প্রশাখায় ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল ফুটেছে। গাছের নিচ থেকে থরে থরে মাথা পর্যন্ত ফুলের সমারোহ। সাদা ধবধবে ফুলগুলো সবুজ পাতার ভেতর থেকে মুখ বের করে যেন হাসছে। ফুলে ফুলে উড়ে এসে বসছে মৌমাছির দল। সারাক্ষণ মৌমাছির গানে মুখর হয়ে আছে গাছটির আশপাশ। পাশেই অন্য গাছেরা নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই আছে নাগেশ্বরের আরও কিছু গাছ। কিছু গাছে ঝাঁক বেঁধে এসেছে নতুন পাতা।
এই সার্কিট হাউসের উল্টো দিকেই জেলা প্রশাসকের বাসভবনে ঢোকার মুখে বেশ বড়সড় একটি নাগেশ্বর ফুলের গাছ আছে। সেটিতেও কিছু ফুল ফুটছে। এ ছাড়া মৌলভীবাজার শহরতলির বর্ষিজোড়া ইকোপার্ক সংলগ্ন বন বিভাগের বন্য প্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ঢোকার সড়কের দুই পাশে অনেকগুলো নাগেশ্বরগাছ আছে।
নাগেশ্বরের আদি নিবাস শ্রীলঙ্কায়। তবে পশ্চিমবঙ্গ ও দক্ষিণ ভারতই না, সমগ্র দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় এই ফুলের দেখা মেলে। নাগেশ্বরের বৈজ্ঞানিক নাম Mesua ferrea। নাগেশ্বর একটি শোভাবর্ধক চিরসবুজ গাছ। বয়স্ক গাছে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসজুড়ে ফুল ফোটে। তবে নাগেশ্বর ফুল সবচেয়ে বেশি ফুটে বসন্তেই। কিছু কিছু গাছে বর্ষায়ও ফুল ফুটতে দেখা যায়। নাগেশ্বর ফুল সুগন্ধিযুক্ত। ফুলগুলো দুধসাদা। কিছু কিছু গাছে হালকা গোলাপি রঙের ফুল হয়ে থাকে। ফুলের ব্যাস ৩ থেকে ৪ ইঞ্চি। প্রতিটি ফুলে চারটি বড়বড় কিছুটা কোঁকড়ানো পাপড়ি থাকে। পাপড়ির রং সাদা ও হালকা গোলাপি হলেও ফুলের মাঝখানে অসংখ্য হলদে সোনালি রঙের পুংকেশর ঝালরের মতো হয়ে থাকে।
অন্যদিকে মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠের উত্তর পাশে এখন হলুদের বন্যা চলছে। মাঠের উত্তর এবং সৈয়দ মুজতবা আলী সড়কের দক্ষিণ পাশে টেকোমার সারি বাঁধা গাছে অগণিত হলুদ ফুল ফুটেছে। পূর্ব থেকে পশ্চিমে একদম এম সাইফুর রহমান অডিটরিয়ামের সম্মুখ পর্যন্ত টেকোমার ফুলে সেজে উঠেছে এলাকা। টুকটুক করে ঝরে পড়ছে হলুদ পাপড়ি। সকাল হলে গাছের নিচের ঘাস, পিচঢালা সড়ক হলুদ হয়ে উঠছে।
মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র মো. ফজলুর রহমান, চিকিৎসক এম এ আহাদ, কানাডাপ্রবাসী ফুলপ্রেমিক নুরুর রহমান, সাহিত্যের ছোটকাগজ ফসল সম্পাদক ও প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ আবদুল খালিকসহ কিছু ফুলপ্রেমিকের যত্ন, পরিচর্যায় এই টেকোমাবীথি এখন শহরের সৌন্দর্যের অংশ হয়ে উঠেছে।