পাবনার ঈশ্বরদীতে ঋণের চুক্তিনামা ভঙ্গের মামলায় ৩৭ কৃষকের জামিন হলেও সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে চেক প্রত্যাখ্যানের আরও একটি মামলা রয়েছে। মামলাটিতে দুজনই জামিনে আছেন।
এদিকে মামলায় জামিনের পর গতকাল সোমবার সকাল থেকেই কৃষকেরা আবার খেতে কাজে নেমেছেন। কথা হয় কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে। তাঁরা বলছেন, তাঁরা সবাই সাধারণ কৃষক। জমিতে কীভাবে উৎপাদন করতে হয়, তাঁরা বোঝেন, তবে ঋণের কাগজপত্র বোঝেন না। এর ফলে ঋণের টাকা পরিশোধ করলেও কোনো কাগজপত্র নেই। তবে তাঁরা বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের কাছে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যাওয়া ঋণের সুদ মওকুফের আবেদন করবেন।
ভাড়ইমারি উত্তরপাড়া সবজি চাষি সমিতির সভাপতি বিলকিস নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ১৬ লাখ টাকা ঋণের ১৩ লাখ টাকা তাঁরা পরিশোধ করেছেন। কিন্তু এ–সংক্রান্ত কোনো কাগজ তাঁদের হাতে নেই। বহুবার বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকে ঘুরেও তাঁরা ঋণের কিস্তির স্টেটমেন্ট তুলতে পারেননি। এর মধ্যেই পরপর দুটি মামলা হয়েছে। প্রতারণার একটি মামলা দিয়ে তাঁদের ৩৭ জনকে আসামি করা হয়েছে। অপর মামলাটি চেক প্রত্যাখ্যানের। যে চেকের বিপরীতে তাঁরা ঋণ নিয়েছিলেন। সেই চেক প্রত্যাখ্যাত দেখিয়ে মামলাটি করা হয়েছে। মামলায় তিনি অন্তত পাঁচবার জামিন নিয়েছেন। এখন ওই মামলা নিয়েও চিন্তায় আছেন।
বিলকিস নাহার আরও বলেন, ‘আমাদের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংক চার লাখ টাকা পাওনা আছে। চক্রবৃদ্ধি হারে এই টাকা বেড়ে ১৩ লাখ হয়েছে। গরিব কৃষকদের পক্ষে সুদের এই টাকা পরিশোধ করা সম্ভব নয়। এর ফলে আমরা বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের কাছে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়ে যাওয়া সুদ মওকুফের আবেদন করছি। তাঁরা সুদ মওকুফ করলে যেভাবেই হোক, বাকি টাকা পরিশোধ করা হবে।’
গতকাল বিকেলে ভাড়ইমারি গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কৃষকদের অনেকেই বাড়িতে নেই। তাঁরা নিজ নিজ কাজে বাড়ির বাইরে। কেউ মাঠে গেছেন, কেউবা অন্য কাজে। তবে পরিবারগুলোতে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরেছে। দুই দিন কারাগারে থাকার পর স্বজনেরা বাড়িতে ফেরায় সবাই শুকরিয়া জানান।
জামিনে মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষক রজব আলী বলেন, ‘আমরা অতি সাধারণ কৃষক। জমিত ফসল ফলাবের পারি। তয় কাগজ বুঝিনে। তাই হয়রানিত পড়া লাগলে।’ রজব আলীর স্ত্রী বুলিয়া খাতুন বলেন, ‘আমার স্বামীকে গ্রেপ্তারের পর কীভাবে মুক্ত করব, চিন্তেয় ছিলেম। আমরা সাধারণ মানুষ, আইন–আদালত বুঝিনে। তিনারা মুক্তি হয়ে আইছেন, আমরা খুশি।’
অপর কৃষক মাহাতাব উদ্দিন বলেন, ‘টিভির খবরে হুনি শউ শউ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে মেলা মানুষ দিচ্ছে না। আর কয়টা টেকার জন্যি আমাগের জেলে যাওয়া লাগল। এডাই কষ্ট লাগিছে।’
এদিকে কৃষকদের ঋণের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে গতকাল দুপুরে জেলা শহরের এলএমবি মার্কেটে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ছোট্ট একটি কক্ষে তিনটি টেবিল নিয়ে কার্যালয়টি। ব্যবস্থাপকসহ তিনজন কার্যালয়ে বসে আছেন। আর আছে একটি শেলফে কিছু পুরোনো কাগজপত্র, একটি আলমারি।
কথা হলো ব্যবস্থাপক কাজী জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জানান, কৃষকদের ঋণের কোনো কাগজপত্র তাঁদের কাছে নেই। মামলার কারণে সব নথি ঢাকার প্রধান কার্যালয়ে রয়েছে। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারলে প্রধান কার্যালয় বলতে পারবে। তবে ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী মামলা হয়েছে, এইটুকু তিনি জানেন। তিনি আরও জানান, সমবায় ব্যাংক সরাসরি কোনো ঋণ দেয় না। জেলা সমবায় অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত সমিতিকে ঋণ দেয়। কৃষকদের ঋণগুলোর অধিকাংশই গরু মোটাতাজাকরণ প্রকল্পের। কৃষকেরা এই টাকা নিয়ে গরু পালন করেন। এরপর গুরু বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করেন। প্রতিটি সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক এই ঋণের দায়ভার গ্রহণ করে থাকেন। তাঁরা ঋণের বিপরীতে একটি চেক দেন এবং একটি চুক্তিনামা করেন। চুক্তিনামায় ঋণগ্রহীতাদের সবার স্বাক্ষর থাকে।
কাজী জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জানামতে, চুক্তিনামার বিপরীতের মামলাটিতে ঋণগ্রহীতাদের সবাইকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অন্যদিকে চেক প্রত্যাখ্যানের মামলায় সমিতির সভাপতি-সম্পাদক অভিযুক্ত হতে পারেন। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত মামলার বাদী বলতে পারবেন।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলার বাদী ও বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক পাবনা কার্যালয়ের তৎকালীন ব্যবস্থাপক সৈয়দ মোজাম্মেল হক বলেন, রসিদ ছাড়া ব্যাংক কোনো টাকা গ্রহণ করে না। কৃষকেরা টাকা পরিশোধ করলে রসিদ থাকত। ১৬ লাখ টাকা ঋণের ১৩ লাখ টাকা পরিশোধ না করার কারণেই মামলাটি হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে এটা চলমান প্রক্রিয়া। এরপরও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখছে।
উপজেলার ছলিমপুর ইউনিয়নের ভাড়ইমারি গ্রামে ‘ভাড়ইমারি উত্তরপাড়া সবজি চাষি সমবায় সমিতি’ নামে কৃষকদের একটি সমিতি রয়েছে। এই কৃষকেরা বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে ১৬ লাখ টাকা ঋণ নেন। পরবর্তীতে তাঁদের বিরুদ্ধে সমবায় ব্যাংক ঋণের শর্তভঙ্গের দায়ে প্রতারণার মামলা করে। মামলায় আদালত ৩৭ কৃষকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ ১২ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে গত শুক্রবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়।