গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার ফকিরহাট দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় ও ফকিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশাপাশি অবস্থিত
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার ফকিরহাট দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় ও ফকিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশাপাশি অবস্থিত

গাইবান্ধার পলাশবাড়ী

এলাকাটি যেন ‘শিক্ষার হাট’

পবনাপুর ইউনিয়নে সরকারি-বেসরকারি ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টিই ফকিরহাট এলাকায়।

দুই কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে গড়ে উঠেছে ১৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সব প্রতিষ্ঠানেই প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছে। পাবলিক পরীক্ষায় ফলও ভালো। এত কম দূরত্বে এত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় এলাকায় ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার হারও। ওই এলাকার নাম ফকিরহাট। এ নামের সঙ্গে মিল রেখে স্থানীয়ভাবে এলাকাটি ‘শিক্ষার হাট’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এটি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার পবনাপুর ইউনিয়নের বালাবামুনিয়া গ্রামে।

পবনাপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহিনুর বেগম বলেন, প্রায় ২০ হাজার মানুষের এ ইউনিয়নে সরকারি-বেসরকারি ৪০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের ১৩টিই ফকিরহাট এলাকায়। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয় সাতটি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় দুইটি, কলেজ দুইটি ও মাদ্রাসা দুইটি।

পলাশবাড়ী উপজেলা সদর থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে বালাবামুনিয়া গ্রাম। এ গ্রামেরই প্রাণকেন্দ্র ফকিরহাট। এখানে একটি বাজার, ঈদগাহ ও ডাকঘরও আছে।

ফকিরহাট বাজার ঘেঁষে সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঘেরা ফকিরহাট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ফকিরহাট দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়। এ দুটি প্রতিষ্ঠান একই ক্যাম্পাসে অবস্থিত। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই কানে এল শিশুদের কলরব। তারা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শ্রেণিকক্ষ থেকেই তাদের পড়ার সুর ভেসে আসছিল। কক্ষে ঢুকে সব ক্লাসেই শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি পাওয়া গেল।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দিলীপ কুমার সরকার বলেন, বিদ্যালয়টি ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। এখন এখানে ১৩৫ শিক্ষার্থী রয়েছে। সর্বশেষ পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার শতভাগ। ২০১৯ সালের মেধাবৃত্তি (ট্যালেন্ট পুলে) দুজন ও সর্বশেষ একজন বৃত্তি পায়।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙিনা পেরিয়েই ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ফকিরহাট দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয়। ততক্ষণে মধ্যাহ্ন বিরতি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখর হয়েছে মাঠ। কেউ ফুটবল নিয়ে মেতেছে, কেউবা খেলছে ক্রিকেট। মেয়েরাও দাঁড়িয়াবান্ধা, বউছিসহ নানা খেলায় ব্যস্ত। এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, এখানে শিক্ষার্থী ৫৬৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ২০০, ছাত্র ৩৬৩। সর্বশেষ পাবলিক পরীক্ষার ফল বেশ ভালো। পাসের হার ৭৯ দশমিক ৩৪। শিক্ষক ১৫ জন, কর্মচারী ৬ জন।

স্থানীয় লোকজন জানান, এ গ্রামে প্রথমে মরহুম মোতাহার আলী খন্দকার ও হবিবর রহমান খন্দকারের সার্বিক সহযোগিতায় ১৯৩৮ সালে ফকিরহাট দ্বিমুখী উচ্চবিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ১৯৬৭ সালে এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ফজলুল হক খন্দকার। তাঁর নেতৃত্বে বিদ্যালয়টি ধীরে ধীরে ভালো ফল করতে থাকে। আশপাশের গ্রামের অভিভাবকেরাও বিদ্যালয়টিতে সন্তানদের পড়াতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিদ্যালয়টিতে এখন ১৪ জন শিক্ষক ও ৫৬৩ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ফজলুল হকের প্রচেষ্টায় আরও কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ফজলুল হক বলেন, ‘সে সময় আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার খোঁজখবর নিয়েছি। দুর্বল শিক্ষার্থীদের বাড়তি পাঠদান, অর্থ ও বই–খাতা দিয়ে সহায়তা করেছি।’

বিদ্যালয় দুটি থেকে বের হয়ে ১০০ গজ পূর্বে এলেই হাতের বাঁ পাশে প্রাচীরঘেরা ফকিরহাট শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজের ক্যাম্পাস। এখানে ঢুকে দেখা গেল, কোনো কক্ষে চলছে পাঠদান। কোথাও আড্ডা দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। কলেজটির শিক্ষার্থী নুরী আকতার বলেন, তিনি এ গ্রামের বাসিন্দা। এখান থেকেই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাস করে এখন স্নাতকে পড়ছেন। কষ্ট করে দূরে কোথাও না গিয়ে বাড়িতে থেকেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন। এতে একদিকে যেমন বাড়ির কাজে সাহায্য করতে পেরেছেন, তেমনি পড়াশোনার খরচও বেঁচেছে।

কলেজটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুল আলিম খন্দকার জানান, তাঁর কলেজে প্রায় ৭০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। সর্বশেষ পাসের হার ৬৩ দশমিক ৬৯। এবার স্নাতকে পাসের হার ছিল ৮৬ ভাগ।

ফকিরহাট বাজার থেকে ৪০০ গজ দক্ষিণে ফকিরহাট আল্লার দরগা দাখিল মাদ্রাসা অবস্থিত। ৪১০ গজ পূর্বে শহীদ খায়রুল আলম উচ্চবালিকা বিদ্যালয়। মাদ্রাসাটি ১৯৯৪ সালে ও বালিকা বিদ্যালয়টি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত। বাজার থেকে ৬৫০ গজ দূরে ২০০৫ সালে ফকিরহাট মদিনাতুল উলুম কওমি হাফিজিয়া মাদ্রাসা গড়ে ওঠে।

বাজার থেকে ৫৫০ গজ দূরে ১৯৮৪ সালে বালাবামুনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬৫০ গজ দূরে ১৯৯০ সালে বালাবামুনিয়া বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ৬০০ গজ দূরে ১৯৯৫ সালে বালাবামুনিয়া ফকিরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। দুই কিলোমিটার দূরে ১৯৮৫ সালে বালাবামুনিয়া আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২০০ গজ দূরে ২০০০ সালে স্থাপিত ফকিরহাট মহিলা কলেজ। দেড় কিলোমিটার দূরে ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বালাবামুনিয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৬০০ গজ দুরে ১৯৮৫ সালে স্থাপিত সমিতিরহাট বালাবামুনিয়া উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

পবনাপুর ইউনিয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (এইউইও) আবদুল হাই বলেন, কাছাকাছি এতগুলো বিদ্যালয় থাকলেও সবগুলোতেই পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী রয়েছে। এত বেশি বিদ্যালয় থাকায় এলাকাটিতে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীও নেই বললেই চলে।

গাইবান্ধার সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এসএম আরশাদ বলেন, প্রতিষ্ঠানের চাহিদা থাকায় ফকিরহাটের ওই সব প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো আগেই গড়ে ওঠেছে। পরবর্তীতে সেগুলোকে সরকারি করা হয়। তবে নতুন করে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি থেকে আরেকটি দূরত্ব ২ কিলোমিটার হতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ন্যূনতম ৫০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হবে। এর কম হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাতে হয়। সে বিষয়ে তারা সিদ্ধান্ত দেবেন। তবে ফকিরহাটের বিদ্যালয়গুলোতে প্রয়োজনীয় শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রয়েছে।