গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই কেন্দ্র চালু করা হয়। এখানে দুটি চিকিৎসকসহ ১০টি পদ রয়েছে। আজও এসব পদে কোনো নিয়োগ হয়নি।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মল্লিকপুর ইউনিয়নের করফা গ্রামে ১৪ মাসে আগে চালু করা হয় ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র। কিন্তু এখনো এখানে কোনো চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। একজন পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা দিয়ে যেনতেনভাবে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এতে এই ইউনিয়নের মা ও শিশুরা যথাযথ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা সদর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দক্ষিণে করফা গ্রামে ওই মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র। গত বছরের ১৫ অক্টোবর সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এই কেন্দ্র উদ্বোধন করেন।
স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতি নড়াইলে যাতি হয়। খরচ বেশি। এই হাসপাতালে ডাক্তার আসলি আমাগের মতো গরিব মানুষ এট্টু বাঁচতে পারতো।তরিকুল শেখ, ভ্যানচালক
লোহাগড়া উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এক বছর আগে চালু হয় এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এ পর্যন্ত এখানে কোনো চিকিৎসক ও অন্য জনবল পদায়ন করা হয়নি। একজন পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা ও একজন অফিস সহায়ক অন্য ইউনিয়ন থেকে এনে কোনোরকম কাজ চালানো হচ্ছে। চিকিৎসকসহ অন্য পদগুলো দ্রুত পূরণের জন্য তিনি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের নড়াইল কার্যালয়ের উপপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। এ ছাড়া বিষয়টি পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে জানানো হয়েছে।
উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের পৈতৃক ভিটায় তাঁর বাবার নামে ওই কেন্দ্রের নামকরণ করা হয়েছে ‘অধ্যাপক শেখ মো. রোকন উদ্দিন আহমেদ ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র’। এটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে ৫ কোটি ৬৬ লাখ ৮৯ হাজার ৮৭২ টাকা।
অধ্যাপক শেখ মো. রোকন উদ্দিন আহমেদ ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র সূত্র জানায়, এখানে রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য পদ আছে ১০টি। এর মধ্যে ২ জন চিকিৎসা কর্মকর্তা, ১ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব), ১ জন ফার্মাসিস্ট, ৪ জন পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা, ১ জন অফিস সহকারী ও অফিস সহায়ক ১ জন। এর সব কটি পদ হাসপাতালটি চালু হওয়ার পর থেকেই শূন্য রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, লোহাগড়া-ইতনা সড়কের পাশে মধুমতী নদীর পাশ ঘেষে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এখানে আছে দুটি তিনতলা ভবন। এর মধ্যে একটি হাসপাতাল ভবন, আরেকটি চিকিৎসক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোয়ার্টার। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবনে রয়েছে পাঁচ শয্যা করে ১০ শয্যার ২টি ওয়ার্ড ও ১০টি কেবিন। আছে আধুনিক অস্ত্রোপচার কক্ষ।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিনই রোগী আসেন। এর মধ্যে নারী রোগীই বেশি। পুরুষ রোগীরাও আসেন সাধারণ চিকিৎসা নিতে। এ তথ্য জানিয়ে কর্মরত পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা রহিমা খাতুন জানান, তিনি ও অফিস সহায়ক মো. নাসিরউদ্দিন এখানে কর্মরত। আর কোনো কর্মী এখানে নেই। তাঁরা দুজনই অন্য ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে এখানে প্রেষণে (ডেপুটেশন) এসেছেন।
রহিমা খাতুন জানান, প্রতিদিন ৬০-৭০ জন রোগী এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। গত সোমবার ৫২ জন রোগী চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে জ্বর, সর্দি ও কাশি নিয়ে এসেছিলেন ৪৩ জন। এ ছাড়া আট শিশু ও এক অন্তঃসত্ত্বা নারীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়।
রহিমা খাতুন বলেন, ‘যেসব রোগী এখানে আসে, তাদের চিকিৎসা ও ওষুধ আমিই দিই। বেশি সমস্যা হলে রোগীদের উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে যেতে বলি।’
সম্প্রতি ষাটোর্ধ্ব রোকেয়া বেগম মল্লিকপুর থেকে এসেছিলেন ঠান্ডা–কাশি ও জ্বরের চিকিৎসা নিতে। তিনি বলেন, ‘বাড়ির কাছে এত বড় হাসপাতাল, তার বোলে ডাক্তার নাই। দেহি এ ওষুধ খাইয়ে জ্বর সারে কি না। গরিব মানুষ টাহা নাই, সে জন্যি লোহাগড়া ডাক্তার দেহাতি যাতি পারিনে।’
পূর্ব মল্লিকপুর গ্রামের তরিকুল শেখ ভ্যানচালক স্ত্রী মিতু খানম (২৩) অন্তঃসত্ত্বা। ডিসেম্বর মাসে তাঁর সন্তান প্রসবের তারিখ রয়েছে। তরিকুল শেখ বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ, দুই বেলা ভাত খাতি পারিনে। স্ত্রীকে ডাক্তার দেখাতি লোহাগড়া ও নড়াইলে যাতি হয়। তাই খরচ বেশি। এই হাসপাতালে ডাক্তার আসলি আমাগের মতো গরিব মানুষ এট্টু বাঁচতে পারতো।’
মঙ্গলহাটা গ্রামের সবুজ কাজীর ছেলে দেড় বছর বয়সী মোরসালিনের শ্বাসকষ্ট হয়েছে। সবুজ কাজী বলছিলেন, ‘এই হাসপাতালে ডাক্তার থাকলে আমরা হাতের কাছেই সব চিকিৎসা পেতাম, ওষুধও পেতাম। বাইরে চিকিৎসা নিতে যাওয়ায় খরচ বাড়ে, সময় অপচয় হয়। এখন লোহাগড়া গিয়ে ডাক্তার দেখাতে হচ্ছে।