ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে কারখানাটির উৎপাদন

সন্তানের ছবি নিয়ে কাঁদছেন নিহত ইয়াসিনের মা নাজমা বেগম। গতকাল রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ৫ নম্বর ক্যানেলএলাকায়
 ছবি: প্রথম আলো

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দুই বছর পূর্তি হয়েছে গতকাল শনিবার। ২০২১ সালের ৮ জুলাই ছয়তলা ভবনের ওই কারখানায় আগুনে প্রাণ হারান ৫৪ জন। এ ঘটনার দুই বছরেও মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি। উল্টো ফায়ার সার্ভিস, প্রধান বৈদ্যুতিক পরিদর্শকের কার্যালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়াই পুরোদমে কারখানাটির উৎপাদন চলছে। এরই মধ্যে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন কারখানার মালিক সজীব গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাসেম, তাঁর চার ছেলেসহ আট আসামির সবাই।

গতকাল সকালে কারখানা এলাকায় গিয়ে ওই কারখানার কয়েকজন কর্মকর্তা ও শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয়। মো. আমজাদ ও সাহারা খাতুন নামের দুজন জানান, বর্তমানে কারখানাটির চারটি ভবনে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। কারখানাটিতে এখন জুস, লাচ্ছি, সেমাই ও নুডলস উৎপাদন করা হয়।

কারখানার একজন কর্মকর্তা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার চার মাস পর পরীক্ষামূলকভাবে কার্যক্রম চালানোর কথা বলে কারখানা চালু করা হয়। শুরুতে চার-পাঁচ শ শ্রমিক কাজ করতেন। ধীরে ধীরে শ্রমিক ও উৎপাদন দুটোই বেড়েছে। এখন প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করছেন। তবে এখনো প্রশাসনিকভাবে উৎপাদনের অনুমোদন পাওয়া যায়নি।

অনুমোদন ছাড়া কীভাবে উৎপাদন চলছে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘সবকিছু ম্যানেজ করেই চালাতে হচ্ছে। উৎপাদন বন্ধ রাখলে অনেক শ্রমিক কাজ হারান। আবার যন্ত্রও নষ্ট হয়।’

ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র ছাড়া কীভাবে কারখানাটি চলছে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস নারায়ণগঞ্জ জোন-২-এর উপপরিচালক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তাঁরা (কারখানা কর্তৃপক্ষ) ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছেন। আমরা ছয় সদস্যের একটি দল কারখানাটি পরিদর্শন করে কিছু ত্রুটি পাই। পরে ছাড়পত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। এখন তারা ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে।’ এ মুহূর্তে আবারও বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায় কে নেবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের করণীয়টুকু করেছি। বাকিটা প্রশাসন দেখবে।’

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পরিদর্শক (রূপগঞ্জ) খালিদ হাসান বলেন, ‘কারখানাটির বিরুদ্ধে আমরা ৫১টি মামলা করেছি। মামলা চলমান থাকায় কারখানার বিষয়টি এখন আদালত দেখবেন।’

জানতে চাইলে কারখানাটির এজিএম (প্রশাসন) ক্যাপ্টেন (অব.) মামুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা অনুযায়ী অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছি। আশা করছি, চলতি মাসেই সব কাজ শেষ হবে। এরই মধ্যে আমরা প্রায় সব ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছি। কারখানাটি এখন অত্যন্ত নিরাপদ।’

জানতে চাইলে অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত নাগরিক তদন্ত কমিটির সদস্যসচিব ও বাদীপক্ষকে আইনি সহায়তাকারী আইনজীবী মাহবুবুর রহমান বলেন, শ্রম আইন ভঙ্গের অভিযোগে কারখানা অধিদপ্তর চাইলেই কারখানাটির বিরুদ্ধে সরাসরি ফৌজদারি মামলা করতে পারে। এ ছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর ক্ষমতার বলে কারখানাটির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করতে পারেন। কিন্তু এ দেশে আইন অনুযায়ী কিছুই হয় না, হাসেম ফুডস তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

ওই অগ্নিকাণ্ডে নিহত একজন শ্রমিক মো. ইয়াসিন। তাঁর মা নাজমা বেগম সন্তানের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। বুকে সন্তানের ছবি জড়িয়ে ধরে বলেন, কারখানার মালিকপক্ষের অবহেলার কারণেই তিনি সন্তানহারা হয়েছেন। অথচ এ ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। সবকিছুই আগের মতো আছে। শুধু তাঁর বুকের ধন আর বেঁচে নেই। তিনি এ ঘটনার দ্রুত বিচার দাবি করেন।

মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের পরিদর্শক মোকছেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকগুলো মৃত্যুর ঘটনা। তদন্ত করতে একটু সময় লাগছে। শিগগিরই প্রতিবেদন দেওয়া যাবে।’