২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ায় ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। গতকাল দুপুরে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর তীরে অবস্থিত ফিশারি ঘাট
২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ায় ঘাটে ফিরছেন জেলেরা। গতকাল দুপুরে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর তীরে অবস্থিত ফিশারি ঘাট

কক্সবাজারের জেলেদের তিন দুঃখ, বৈরী আবহাওয়া, জলদস্যু আর নিষেধাজ্ঞা

ইলিশ ধরার মৌসুম শেষ। তাই কক্সবাজার উপকূলে মাছ ধরার ট্রলারগুলো ঘাটে ফিরে আসছে। কিছু ট্রলারে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ ধরা পড়লেও বেশির ভাগ ট্রলার মাছশূন্য। হতাশ জেলেরা জানান, ঘূর্ণিঝড়, ঘনঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা এবং জলদস্যুদের উৎপাতের কারণে কয়েক মাস খুব বেশি মাছ ধরার সুযোগ হয়নি তাঁদের। এখন শুরু হয়েছে ২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞার সময় প্রতিটি জেলে পরিবারে ২৫ কেজি করে যে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা যথেষ্ট নয়। আবার অনেকের ভাগ্যে সেই চালও জুটবে না।

জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় গতকাল শনিবার দিবাগত রাত থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন বঙ্গোপসাগরে মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করে সরকার। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান বলেন, নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে নৌবাহিনী-কোস্টগার্ডের পাশাপাশি মৎস্য বিভাগ অভিযান পরিচালনা করবে। ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে তৃণমূল পর্যায়ে সভা করে জেলে ও ট্রলারমালিকদের সচেতন ও সতর্ক করা হয়েছে। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় প্রত্যেক জেলে ২৫ কেজি করে ভিজিএফের চাল পাবেন। জেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৩ হাজার ১৯৩। ছোট বড় ছয় হাজার ট্রলারে শ্রমিক রয়েছেন ১ লাখ ২০ হাজার।

কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ায় গভীর সাগর থেকে ট্রলারগুলো ঘাটে ফিরতে শুরু করেছে। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত দেড় হাজার ট্রলার ফিরে এসেছে।

চলতি মৌসুমে সাগরে একাধিক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। লঘুচাপ, নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় ১০-১২টি। গত ২০ মে থেকে শুরু হওয়ায় ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা ২৩ জুলাই শেষ হয়। সব মিলিয়ে চলতি বছরের চার মাস জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে পারেনি। ধার দেনায় চলে জেলেদের সংসার।

শূন্য হাতে ঘরে ফেরা

গতকাল দুপুরে শহরের নাজিরারটেক উপকূলে গিয়ে দেখা গেছে শতাধিক ট্রলার ভিড়েছে। কিছু ট্রলারে ইলিশসহ সামুদ্রিক মাছ দেখা গেলেও অধিকাংশ ট্রলার ছিল মাছশূন্য।

সেখানে কথা হয় এফবি শাওন নামের ট্রলারের জেলে গিয়াস উদ্দিনের (৫০) সঙ্গে। ঘাটের এক পাশে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। চোখেমুখে বিরক্তি আর হতাশার ছাপ। কথা বলতে চাইলে বলেন, বঙ্গোপসাগরের সেন্ট মার্টিন উপকূলে ইলিশ ধরা পড়ার খবর পেয়ে সেখানে ছুটে যান তাঁর ট্রলারের ২৩ জেলে। গত বুধবার জাল ফেলার মুহূর্তে সাগরে শুরু হয় গোলাগুলি। মাছ না ধরেই তাঁদের ট্রলারটি ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। ওই সময় মিয়ানমারের নৌবাহিনীর গুলিতে বাংলাদেশি দুই জেলে নিহত হন। তাই পরিশ্রম, টাকা সবই গেছে পানিতে। হতাশ কণ্ঠে গিয়াস বলেন, কীভাবে সংসার চালাবেন, জানেন না। এই অবস্থায় বাড়িতেও ফিরতে ইচ্ছা করছে না।

আরেকটি ট্রলারের জেলে সাইফুল আলম (৫১) জানালেন তাঁরা তবু কিছু মাছ পেয়েছেন। কিন্তু নৌকা আর জালের খরচও তাতে উঠবে না। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার পুরো দিন সাগরে জাল ফেলে ৫০-৬০ হাজার টাকার মাছ পাওয়া গেছে। এরপর মাছ না ধরেই ঘাটে ফিরে আসেন তাঁরা। কারণ, গতকাল থেকে শুরু ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা।

এফবি রহিমা ট্রলারের জেলে কামরুল ইসলাম (৪৫) বলেন, চলতি মৌসুমে সাগরে একাধিক ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়েছে। লঘুচাপ, নিম্নচাপ সৃষ্টি হয় ১০-১২টি। গত ২০ মে থেকে শুরু হওয়ায় ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা ২৩ জুলাই শেষ হয়। সব মিলিয়ে চলতি বছরের চার মাস জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে পারেনি। ধারদেনায় চলে জেলেদের সংসার। এখন ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় সংসার কী দিয়ে চলবে, জানা নেই। কামরুলের বাড়ি চকরিয়ার বারবাকিয়াতে। সংসারে স্ত্রী ও চার সন্তান। দীর্ঘ দেড় মাস পর তিনি বাড়ি ফিরছেন খালি হাতে।

নাজিরারটেক উপকূলে ফিরে আসা এফবি সায়মা ট্রলারের জেলে দিল মোহাম্মদ (৪৫) বলেন, গভীর সাগর থেকে সামান্য মাছ নিয়ে তাঁদের ট্রলারটি গতকাল বিকেলে ঘাটে পৌঁছেছে। ট্রলারের ২১ জেলে খালি হাতে বাড়ি ফিরেছেন। ট্রলার পাহারার জন্য তিনি থেকে গেছেন। খালি হাতে বাড়ি ফিরতে তাঁর মনে সায় দিচ্ছে না। বাড়িতে অসুস্থ মা, স্ত্রী ও তিন সন্তান আছে।

টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের পর গত ১৫ জুলাই থেকে সাগরে ইলিশ ধরা পড়েছিল। বেশ কিছু ট্রলার ইলিশ ধরে ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়েছিল। কিন্তু অক্টোবর মাসের শুরু থেকে সাগরে জলদস্যুদের উৎপাত বাড়তে থাকে। দস্যুরা ট্রলারের মাছ, জাল, জ্বালানি তেল লুটে করেই থামছে না, জেলেদের গুলি করে ও পিটিয়ে আহত করেছে। প্রাণহানির ভয়ে বহু জেলে মাছ ধরা বন্ধ রাখেন।

কয়েকটি ট্রলারের জেলেরা জানান, টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণের পর গত ১৫ জুলাই থেকে সাগরে ইলিশ ধরা পড়েছিল। বেশ কিছু ট্রলার ইলিশ ধরে ৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়েছিল। কিন্তু অক্টোবর মাসের শুরু থেকে সাগরে জলদস্যুদের উৎপাত বাড়তে থাকে। দস্যুরা ট্রলারের মাছ, জাল, জ্বালানি তেল লুটে করেই থামছে না, জেলেদের গুলি করে ও পিটিয়ে আহত করেছে। প্রাণহানির ভয়ে বহু জেলে মাছ ধরা বন্ধ রাখেন।

কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির তথ্যমতে, গত সাত দিনে সাগরে জলদস্যুরা অন্তত ২০টি ট্রলারে লুটপাট চালিয়েছে। এ সময় ট্রলারের কয়েক কোটি টাকার মাছ, জাল ও জ্বালানি তেল লুট করা হয়। দস্যুদের গুলি ও পিটুনিতে আহত হন অন্তত ৩৪ জেলে। সর্বশেষ ৯ অক্টোবর সাগরে লুটপাটে শিকার হয় দুটো ট্রলার। লুটপাটে বাধা দেওয়া দস্যুদের গুলিতে আহত হন একটি ট্রলারের জেলে জহির আহমদ। তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাঁর বাড়ি নোয়াখালী।

ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক আহমদ বলেন, ২০২৩ সালের মার্চ মাসে সাগরে ডাকাতি করতে গিয়ে ১০ জলদস্যুর মৃত্যু ঘটে। এরপর কয়েক মাস জলদস্যুদের তৎপরতা বন্ধ ছিল। কিন্তু সম্প্রতি ইলিশ ধরার মৌসুমে জলদস্যু বাহিনী আবার তৎপর হয়। বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলে লুটপাটে জড়ায় চার-পাঁচটি সশস্ত্র দস্যু বাহিনী।

জেলেপল্লিতে হাহাকার

টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ ও জালিয়াপাড়ায় দুই হাজার জেলে পরিবারের বসবাস। নাফনদী ও বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরে জেলেদের পরিবার চলে। টানা ৯ মাস ধরে চলা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতিতে অধিকাংশ জেলের সাগর ও নাফ নদীতে নামতে পারছে না। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে চিন্তিত পরিবারের সদস্যরা।

দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন জেলে সব্বির আহমদ। তিনি বলেন, গতকাল সকালে খালি হাতেই তিনি বাড়ি ফিরেছেন। এলাকায় আয়রোজগারের বিকল্পও কাজ নেই।

জালিয়াপাড়া ক্ষুদ্র মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি আবদুল গণি বলেন, জালিয়াপাড়া ও শাহপরীর দ্বীপের পাঁচ শতাধিক নৌযান কয়েক মাস ধরে ঘাটে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে। হাজারো জেলে পরিবার অভাব অনটনে অমানবিক জীবনযাপন কাটালেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কোনো সহায়তা জুটছে না।

হিউমেন রাইটস ডিফেন্ডারস ফোরাম কক্সবাজারের সভাপতি আইনজীবী আবদুস শুক্কুর বলেন, রাখাইন রাজ্যের চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে শুধু টেকনাফ উপজেলায়  ১০ হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েছেন। তাঁদের জীবিকা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই।