লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের মুরুলী চন্দ্র রায় নলকূপ বসানোর কাজ করতেন। নিজের কোনো জমি নেই। এক ছেলে, দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে ছিল তাঁর ছোট সংসার। তিনি ছিলেন একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। সেই মুরুলীই শুক্রবার কালীগঞ্জের চন্দ্রপুরের বুড়িরহাট সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। মুরুলীকে হারিয়ে দিশাহারা তাঁর পরিবার। তাঁর বাড়িতে চলছে মাতম। মুরলীর মৃত্যুতে সংসার কীভাবে চলবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন তাঁর স্ত্রী।
মুরুলী চন্দ্র রায় (৪২) কালীগঞ্জের চন্দ্রপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর বাংলা পাড়া গ্রামের সুশীল চন্দ্র রায়ের ছেলে। গত শুক্রবার গভীর রাতে চন্দ্রপুরের বুড়িরহাট সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে তিনি নিহত হন। এই সময় আরও দুই বাংলাদেশি গুলিবিদ্ধ হন। তাঁরা হলেন কালীগঞ্জের চন্দ্রপুর গ্রামের মিজানুর রহমান (৩২) ও লিটন মিয়া (৩৮)। মুরুলী চন্দ্র রায় নিহত হওয়ার ঘটনায় লালমনিরহাট-১৫ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোফাজ্জল হোসেন আকন্দ কড়া প্রতিবাদ জানিয়ে বিএসএফের কাছে চিঠি দিয়েছেন।
গতকাল শনিবার বিকেলে লালমনিরহাট সদর হাসপাতালের মর্গে মুরুলী চন্দ্র রায়ের লাশের ময়নাতদন্ত হয়। এরপর তাঁর লাশ পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করে কালীগঞ্জ থানার পুলিশ। গত শনিবার রাতে কালীগঞ্জের চন্দ্রপুরের বোয়ালমারী ঘাট শ্মশানে মুরুলী চন্দ্র রায়ের মরদেহ দাহ করা হয়েছে।
আজ রোববার দুপুরে লালমনিরহাট জেলা শহর থেকে আনুমানিক ৩০ কিলোমিটার উত্তর পশ্চিমে কালীগঞ্জের উত্তর বাংলা পাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মুরুলী চন্দ্র রায়ের পরিবারের সদস্য ও স্বজনেরা আহাজারি করছেন। তাঁর ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রী বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। স্বজনেরা তাঁদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
মুরুলী চন্দ্র এলাকায় নলকূপ বসানোর কাজ করতেন। ওই কাজ না থাকলে মাঝেমধ্যে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কোনো ফসলি জমি নেই। পৈতৃক সূত্রে মাত্র ছয় শতক জমিতে বসতভিটা।
মুরুলী চন্দ্র রায়ের স্বজন ও পরিবারের সদস্যরা জানালেন, মুরুলী চন্দ্র এলাকায় নলকূপ বসানোর কাজ করতেন। ওই কাজ না থাকলে মাঝেমধ্যে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। স্ত্রী রাধা রানী (৩৫), এক ছেলে রতন চন্দ্র রায় (১৭), দুই কন্যা রতনা রানী রায় (১৪) ও রীতি রানীকে (১০) নিয়ে তাঁর সংসার। কোনো ফসলি জমি নেই। পৈতৃক সূত্রে মাত্র ছয় শতক জমিতে বসতভিটা। এই জমির ওপর টিনের একটি থাকার ঘর, একটি রান্নাঘর এবং গবাদিপশু রাখার জন্য একটি টিনের গোয়ালঘর রয়েছে।
শুক্রবার রাতে মুরুলী চন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী রাধা রানী রায়ের শেষ কথা হয়েছিল। ওই বিষয়ে জানতে চাইলে শোকে মুহ্যমান রাধা রানী বলেন, ‘গত শুক্রবার বাড়িতে দুপুরের ভাত খাইছেন স্বামী (মুরুলী চন্দ্র রায়)। সন্ধ্যা সাতটার দিকে ফোন এলে তায় (তিনি) বাড়িত থাকি বাইরে চলি গেছেন। রাইতে বাড়িত আসেন নাই, আর রাইতের খাবারও খায় নাই।’ তিনি বলেন, বর্ডারে বিএসএফের গুলিতে তিনি (মুরুলী চন্দ্র রায়) আহত হওয়ার খবরটা শনিবার ভোর পাঁচটার দিকে শুনতে পেয়েছেন। তাঁর স্বামীর সঙ্গে থাকা লোকেরা তাঁকে চিকিৎসার জন্য জন্য রংপুর নিয়ে যাওয়ার পথেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
রাধা রানী রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘ভারতের বর্ডারে যায়া দোষ করি থাকলে বিএসএফ ওমাকগুলাক আটকেয়া ভারতের জেলোত থুইতো, জেল খাটি দেশে ফিরি আসলোহায় (আসত)। কিন্তু গুলি করি মারি ফেলাইলো, এলা হামার সংসার চলবে ক্যামুন করি। মেয়ে দুইটাক পড়া লেখা করার খরচ কায় দিবে, হামরা বাচিম কীভাবে? বড় ছেলেটার পা ভাঙা। আয়রোজগার করতে পারে না। হামার চারদিকে খালি আন্ধার (অন্ধকার)।’
মুরুলী চন্দ্র রায়ের বড় সন্তান চন্দ্র রায় (১৭) উত্তর বালাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে। আর্থিক সংকটের কারণে তাঁর আর মাধ্যমিকে পড়া হয়নি। ট্রলির শ্রমিক হিসেবে কাজ করত সে। ৬-৭ মাস আগে ট্রলি থেকে পড়ে গিয়ে ডান পা হাঁটুর নিচে ভেঙে যায়। ধারদেনা করে ভাঙা পায়ের চিকিৎসা করা হয়েছে। এখন সে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটে।
মুরুলী চন্দ্র রায়ের বড় মেয়ে রতনা রানী রায় উত্তর বালাপাড়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। ছোট মেয়ে রীতি রানী রায় স্থানীয় উত্তর বালাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। তারা পড়াশোনা করতে চায়। কিন্তু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি বিএসএফের গুলিতে নিহত হওয়ায় দুই মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন মুরুলীর স্ত্রী রাধা রানী রায়।
কালীগঞ্জের চন্দ্রপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দীনবন্ধু রায় বলেন, খবর পেয়ে মুরুলী চন্দ্র রায়ের পরিবারটির খোঁজখবর নিয়েছি। ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে পরিবারটিকে সাহায্য করার চেষ্টা করা হবে।
এই বিষয়ে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) জহির ইমাম বলেন, নিহত মুরুলী চন্দ্র রায়ের বড় ছেলে রতন অথবা তাঁর স্ত্রী রাধা রানী আর্থিক সহায়তার জন্য লিখিত আবেদন করলে তাঁদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
উত্তর বালাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও লোহাকুচি স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক গজেন্দ্রনাথ রায় (৫০) বলেন, মুরুলী চন্দ্র রায়ের পরিবারটি একটি হতদরিদ্র পরিবার। বিএসএফের গুলিতে মুরুলী চন্দ্র নিহত হলেন। এখন তাঁর সংসার কীভাবে চলবে, সেটা একটা প্রশ্ন। সরকার মুরালীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা না দিলে তাঁর মেয়ে দুটির পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এমনকি তাদের বাল্যবিবাহও হয়ে যেতে পারে।