মানব পাচার

লিবিয়ায় ৯ মাসের বন্দিজীবনে দিনে দুইবার পাউরুটি পেতেন আশেক, দেওয়া হতো না পানি

লিবিয়ায় নয় মাসের বন্দিজীবন কাটিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন চট্টগ্রামর বাঁশখালীর মোহাম্মদ আশেক
ছবি সংগৃহীত

‘একটি ক্যাম্পে আটকে রেখে দিনে দুইবার পাউরুটি খেতে দেওয়া হতো, পানি দিত না। আমরা শৌচাগারের পানি পান করে বেঁচে ছিলাম।’ পাচারকারীদের মাধ্যমে লিবিয়া গিয়ে নিজের জিম্মিদশার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এসব কথা বলেন চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারার বাসিন্দা মোহাম্মদ আশেক। এক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশের কূটনৈতিক তৎপরতায় দেশে ফেরেন তিনি। তাঁর মতো গত এক সপ্তাহে দেশে ফিরেছেন লিবিয়ায় আটকে পড়া বাঁশখালী উপজেলার আরও সাতজন। ফিরে আসার প্রক্রিয়া চলছে আরও একজনের।

আশেক ছাড়াও দেশে ফিরে আসা বাকি সাতজন হলেন গন্ডামারা ইউনিয়নের বাসিন্দা রুকনুল ইসলাম, মো. মোরশেদুল আলম, মোহাম্মদ কাউছার মিয়া, আজগর হোসেন, গিয়াস উদ্দিন; কাথরিয়া ইউনিয়নের বাগমারা এলাকার মোহাম্মদ করিম, পৌরসভা এলাকার আইয়ুব আলী। ফেরার চেষ্টায় রয়েছেন ইব্রাহিম খলিল। তিনি আশেকের বড় ভাই।

জানতে চাইলে আশেক বলেন, তিনি ২০২২ সালের মার্চে দালালের মাধ্যমে লিবিয়া যান। দেশে তাঁর কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। দুবাই, সিরিয়া হয়ে লিবিয়াতে নেওয়ার পর আরও ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা নেয় দালাল চক্র। লিবিয়াতে পৌঁছানোর পরই তাঁর পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়। লিবিয়ার বেনগাজিতে তাঁকে আরেকটি গ্রুপের কাছে তুলে দেন দালাল চক্রের সদস্যরা।

আশেক বলেন, ‘বেনগাজিতে যে চক্রটির কাছে তুলে দেওয়া হয়, তাদের কাছে প্রায় হাজারখানিক শ্রমিক ছিল। একটি বড় কক্ষে সবাই একত্রে ঘুমাতাম। মাসে দুই থেকে তিন দিন কাজ দেওয়া হতো। পাঁচ মাসের মতো সেখানে ছিলাম। হঠাৎ একদিন সেখানে ৪০ থেকে ৪৫ জনের একটি ডাকাত দল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হানা দেয়। তারা সবার মুঠোফোন, টাকাসহ অন্যান্য মালামাল নিয়ে নেয়। তারপর অস্ত্রের মুখে সবাইকে একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায় তারা।’

লিবিয়ায় আটকে পড়া বাঁশখালী উপজেলার আরও সাতজন সম্প্রতি দেশে ফেরেন

ডাকাত দল ক্যাম্পে তাঁদের আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা করে বলে জানান আশেক। তিনি বলেন, ‘বাঁশখালীর নয়জনই ডাকাত দলের ক্যাম্পে আটকে ছিলাম। আমাদের প্রত্যেককে মুক্তিপণের জন্য পরিবারের সদস্যদের ফোন দিতে বলা হয়। বাংলাদেশের দালাল চক্রের সদস্যদের সঙ্গেও একবার কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয়।

আমরা বুঝতে পারি, দেশের দালাল চক্রটির সঙ্গে লিবিয়ার ডাকাত দলের যোগসাজশ রয়েছে। ডাকাত দলের কাছে প্রায় প্রত্যেকে দুই থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা পরিশোধ করেছি।’

লিবিয়ায় নয় মাসের বন্দিজীবন কাটিয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন চট্টগ্রামর বাঁশখালীর মোহাম্মদ আশেক

আশেক আরও বলেন, ‘প্রায় ৯ মাস পর আমাদের একটি জঙ্গল ছেড়ে দেওয়া হয়। তিন মাসের মতো লতাপাতা খেয়ে ছিলাম। মুঠোফোন না থাকায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। পরে গত সেপ্টেম্বরে সবাই পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে সমর্থ হই।’

বাঁশখালীর স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেড় বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে একটি পাচারকারী চক্রের মাধ্যমে লিবিয়া যান বাঁশখালীর এই ৯ বাসিন্দা। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নিতে গত সেপ্টেম্বর পরিবারের সদস্যরা উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করেন। পরে লিবিয়া দূতাবাসের সহায়তায় ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া লিবিয়ায় আটকে পড়া বাঁশখালীর এসব বাসিন্দাকে দেশে আনার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ফিরে আসার যাতায়াত খরচ ভুক্তভোগীদের পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে।

ফিরে আসা মো. মোরশেদুল আলম বলেন, ‘দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় গিয়ে এমন কষ্ট পেয়েছি, তা ভাবলে গা শিউরে ওঠে। প্রশাসনের সহায়তায় দেশে ফিরতে পেরেছি, এটিই বড় কথা। মনে হচ্ছে, পুনরায় জীবন ফিরে পেয়েছি। দেশে রিকশা চালিয়ে রোজগার করব, কিন্তু এমন ভুল আর করব না।’

মোহাম্মদ কাউছার মিয়া বলেন, ‘টাকা খরচ করে লিবিয়ায় গিয়ে সেখানে জিম্মি হয়ে পড়ি। প্রতিদিনই মনে হতো, এই বুঝি মরে যাব। দেশে ফিরে আসতে পারব, কখনো ভাবিনি। আমাদের এই দুর্দশার জন্য দায়ী দালালদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।’
জানতে চাইলে বাঁশখালীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহায়তায় ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে লিবিয়া থেকে আটজনকে ফিরিয়ে আনতে পেরে ভালো লাগছে। দেশে তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির চেষ্টা করব। ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে বিষয়ে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে।’