‘আমার স্বামী মরতে পারে না, আমার সন্তান এতিম হতে পারে না। আল্লাহ, তুমি আমার স্বামীকে ফিরিয়ে দাও। কালকেই সে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমার ছেলেকে বলেছিল, ধান বিক্রি করে কিছু ঋণ আছে, সেগুলো শোধ করবে আর ছেলেকে জামা-জুতা কিনে দেবে। কোথায় গেল আমার আমার স্বামী, কোথায় গেল আমার ছেলের বাবা, আমার এই অবুঝ সন্তানের কী হবে এখন?’
আজ রোববার সকালে বাড়ির উঠানে বসে একমাত্র ছেলে আবদুল্লাহ আল মাহীকে (১৩) জড়িয়ে ধরে এভাবেই বিলাপ করছিলেন নাসরিন আক্তার ওরফে চামেলী। তিনি গতকাল শনিবার পঞ্চগড়ে পুলিশ-বিএনপি সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যাওয়া আবদুর রশিদ আরেফিনের স্ত্রী। বিলাপের একপর্যায়ে মূর্ছা যান নাসরিন।
আবদুর রশিদ (৫০) পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার ময়দানদিঘি ইউনিয়নের পাথরাজ-চন্দনপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি ময়দানদিঘি ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। এর আগে তিনি ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
রোববার সকালে আবদুর রশিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িজুড়ে কান্নার রোল। ঘরের ভেতর বিছানায় বসিয়ে রাখা হয়েছে আবদুর রশিদের মা আনোয়ারা বেগমকে (৭২)। লাশের অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের কান্নায় চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না বাড়িতে জড়ো হওয়া প্রতিবেশীরাও। এরই মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সদস্যসচিব ফরহাদ হোসেনসহ বিএনপির নেতা-কর্মীরা আবদুর রশিদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্বজনদের সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেউ কেউ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন লাশ দাফনের।
পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছয় ভাই দুই বোনের মধ্যে আবদুর রশিদ ছিলেন দ্বিতীয়। দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় ভীমপুকুর ডাঙ্গাপাড়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তবে ওই বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত না হওয়ায় চার বছর ধরে একরামুল হক বিদ্যানিকেতন নামের স্থানীয় একটি কিন্ডারগার্টেনে অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। এ ছাড়া স্থানীয় পাথরাজ বাজারে একটি ওষুধের দোকানও চালাতেন তিনি। স্ত্রী, এক ছেলে ও মাকে নিয়ে সংসার তাঁর। পৈতৃক সূত্রে পাওয়া অল্প কিছু জমিতে করতেন চাষাবাদ। এ ছাড়া বছরখানেক আগে মারা যাওয়া বড় ভাই আনোয়ার হোসেনের সংসারটির দেখভাল করতেন তিনি। তিনি হৃদ্রোগী ছিলেন। এর আগে ২০১৬ সালে তাঁর ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়েছিল।
আবদুর রশিদের স্ত্রী নাসরিন আক্তার বলেন, ‘মাত্র ৩০ দিন আগে আমার বাবা মারা গেছেন। কয়েক দিন আগে আমি এতিম হলাম, এখন আমার ছেলে এতিম হলো। সে তো অবুঝ শিশু। গতকাল তারা বাবা-ছেলে ধান বিক্রি নিয়ে আলাপ করছিল। বাবাকে ছাড়া সে একমুহূর্ত থাকতে পারে না। ওর এখন কী হবে?’
মাত্র ৩০ দিন আগে আমার বাবা মারা গেছেন। কয়েক দিন আগে আমি এতিম হলাম, এখন আমার ছেলে এতিম হলো। সে তো অবুঝ শিশু। গতকাল তারা বাবা-ছেলে ধান বিক্রি নিয়ে আলাপ করছিল। বাবাকে ছাড়া সে একমুহূর্ত থাকতে পারে না। ওর এখন কী হবে?আবদুর রশিদের স্ত্রী নাসরিন আক্তার
পুলিশ, বিএনপির নেতা-কর্মী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল দুপুরে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে পঞ্চগড় জেলা বিএনপি মিছিলের আয়োজন করে। বেলা আড়াইটার দিকে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন। সড়কে মিছিল বের করার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। পরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকলে পুলিশ দফায় দফায় কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এ সময় শহরের দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় পুলিশসহ প্রায় অর্ধশত মানুষ আহত হন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে আবদুর রশিদ মারা যান।
মারা যাওয়া আবদুর রশিদের সঙ্গে বিএনপির মিছিলে ছিলেন বোদা উপজেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. আলমগীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জেলা শহরের ধাক্কামারা এলাকায় মিনা বাজারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে জেলা বিএনপি কার্যালয়ের সামনে যাই। এ সময় আবদুর রশিদসহ আমরা পাশাপাশি ছিলাম। পরে পুলিশ লাঠিপেটা ও টিয়ার গ্যাস মারলে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। এ সময় আমি আবদুর রশিদকে হারিয়ে ফেলি। পরে শুনি তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। পরে সেখানে গিয়ে তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখি।’
লাশের ময়নাতদন্তের পর পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তৌফিক আহমেদ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ময়নাতদন্তের সময় আবদুর রশিদের বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ঘষা লাগার দাগ পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে তাঁর বুকে ওপেন হার্ট সার্জারির পুরোনো দাগ ছিল। এ ছাড়া তাঁর শরীরের অন্য কোথাও তেমন কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। প্রাথমিকভাবে তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পুলিশের দাবি, ওই ব্যক্তি পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় মারা যাননি। তিনি হৃদ্রোগ ও স্ট্রোকের কারণে মারা গেছেন। আগে থেকেই তিনি হৃদ্রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং তাঁর তিনটি বাইপাস সার্জারি করা ছিল।
পঞ্চগড়ের পুলিশ সুপার এস এম সিরাজুল হুদা রোববার দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, শনিবারের সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন জামায়াত কর্মীসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।