বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শিক্ষার্থীদের ওপর সশস্ত্র সন্ত্রাসী হামলা, ককটেল বিস্ফোরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য, চার শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের আসামি করা হয়েছে।
মামলায় সাক্ষী হিসেবে হিসেবে যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের কয়েকজন দাবি করেছেন, মামলার বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানেন না। এরপর থেকে মামলাটি নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনা শুরু হয়েছে।
গত বুধবার কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় বাদী হয়ে মামলাটি করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সদ্য সাবেক শিক্ষার্থী মো. শাখাওয়াত হোসেন। মামলায় নিজেকে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক বলে দাবি করেছেন। শাখাওয়াত কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার অশ্বদিয়া গ্রামের মো. আবু তাহেরের ছেলে। তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের দাবি, শাখাওয়াত আন্দোলনে ছিলেন, কিন্তু তিনি সমন্বয়ক নন। মামলাটিও তাঁদের সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়নি।
এ মামলায় সাক্ষী হিসেবে আটজন শিক্ষার্থীর নাম-ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁরা হলেন গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী মো. গোলাম মোস্তফা, লোকপ্রশাসন বিভাগের মো. হাসান অন্তর, একই বিভাগের তানভির হোসাইন মজুমদার, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের হাসান ইমাম ফরহাদ, একই বিভাগের বিভাগের সৌরভ সিদ্দিকী ও তৌহিদুল ইসলাম ওরফে জিসান, অর্থনীতি বিভাগের রায়হান এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী রাহিম।
মামলার অন্তত তিনজন সাক্ষী অভিযোগ করে বলেন, তাঁদের না জানিয়ে সাক্ষী করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ১৬তম ব্যাচের রায়হান নামের আরেক শিক্ষার্থীকেও সাক্ষী করা হয়েছে। তবে এই নামে ১৬তম ব্যাচে কোনো শিক্ষার্থী নেই।
আজ শুক্রবার দুপুরে মামলার সাক্ষী সৌরভ সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এ মামলার বিষয়ে কিছুই জানি না। আমার সঙ্গে ন্যূনতম কোনো পরামর্শ করা হয়নি। এ জন্য ঘটনা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছি। এভাবে আমাকে মামলায় সাক্ষী করার ঘটনায় নিন্দা জানাচ্ছি।’
আরেক শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এ মামলার বিষয়ে কিছুই জানি না। সেদিন বিকেলে পুলিশের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ঝামেলা হয়ছিল জানি। কিন্তু কোন ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা হয়েছে, সেটা আমার জানা নেই। আমার নাম দেখি সাক্ষীর তালিকায়, যা আমার জন্য বিব্রতকর।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ১৬তম ব্যাচে রায়হান নামের যে শিক্ষার্থীর কথা মামলার এজাহারে সাক্ষী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, এই নামে ওই ব্যাচে কোনো শিক্ষার্থী নেই বলে জানা গেছে। তবে একই বিভাগের ১৫তম ব্যাচে রায়হান নামের এক শিক্ষার্থী রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যদি এটা আমার নাম হয়ে থাকে, তাহলে আমি জানি না। আমার সঙ্গে সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে কেউ যোগাযোগ করেননি। বিষয়টি নিয়ে আমিও বিব্রত।’
মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এ এফ এম আবদুল মঈনকে। মামলায় অভিযুক্ত চার শিক্ষকের মধ্যে আছেন সাবেক প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকী, সাবেক সহকারী প্রক্টর আবু উবাইদা রাহিদ, অমিত দত্ত এবং ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেলের (আইকিউএসি) সাবেক পরিচালক ও লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক রশিদুল ইসলাম শেখ। অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সেকশন অফিসার রেজাউল ইসলাম, সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহী, বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাকির হোসেন, কর্মচারী পরিষদের সভাপতি জসিম উদ্দিন, কম্পিউটার অপারেটর মো. মহসিন, অফিস সহকারী ফখরুল ইসলাম, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বিপ্লব চন্দ্র দাস, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমানসহ ৩৫ জন। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ১১ জুলাই বেলা ১১টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ছিল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ী বিশ্বরোড এলাকায়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক থেকে বের হলে একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী মারাত্মক আহত হন। এ সময় এলোপাতাড়ি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মঈন ও প্রক্টর কাজী ওমর সিদ্দিকীর নির্দেশে এবং বাকি তিন শিক্ষকসহ সাবেক ছাত্রলীগ নেতা রেজাউল ইসলামের মদদে কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্রলীগের নেতারা এ হামলা চালান।
মামলার বিষয়ে বাদী শাখাওয়াত হোসেন আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু রায়হান ও মোহাম্মদ সাকিব হোসাইনসহ সবাই মিলে বসে মামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সাকিব এ মামলার বাদী হতে চেয়েছিল। তখন সবাই বলল আমার যেহেতু পড়াশোনা শেষ, তাই আমি মামলার বাদী হব। মামলার সব সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলা আমার সম্ভব হয়নি। তবে অন্য সমন্বয়কেরা কথা বলেছেন বলে শুনেছি। মামলা দায়েরের দুই দিন পর সাক্ষীদের কেউ কেউ শিক্ষকদের চাপে এখন উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। তবে সাক্ষীদের সবাই সেদিন আহত হয়েছেন।’
শুক্রবার দুপুরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক মোহাম্মদ সাকিব হোসাইন বলেন, ‘এ মামলার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলাটি করা হয়নি। তিনি (শাখাওয়াত) নিজ উদ্যোগে মামলাটি দায়ের করেছেন। এ ছাড়া তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন, তবে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের তালিকায় তাঁর নাম নেই। মামলা ও সাক্ষীর বিষয়ে তিনি ভালো বলতে পারবেন।’
শাখাওয়াত হোসেনের দাবি, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের একজন তিনি। ৫ আগস্টের পর ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন দলের লোকজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢুকে নিজেদের সমন্বয়ের দাবি করছেন। আর প্রকৃত সমন্বয়কদের নাম বাদ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে মামলাটি গ্রহণ করা হয়েছে। মামলার সার্বিক বিষয় তদন্তে বেরিয়ে আসবে। পুলিশের তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।