যশোরের মনিরামপুর উপজেলার টেকারঘাট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির তিনটি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি ওই নিয়োগে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর আরও দুটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক বর্তমানে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁকে প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দেওয়া হলে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদটি শূন্য হবে। এ ছাড়া ছয় মাস পর বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির একটি পদ শূন্য হবে। যুবলীগ নেতা উদয় শংকর বিশ্বাস হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে বিদ্যালয়ের এই সাতটি পদের নিয়োগসংক্রান্ত বিরোধ।
এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। হত্যা মামলার এজাহারেও এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে। গত সোমবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে মনিরামপুরের টেকারঘাট বাজার থেকে বাজার করে মোটরসাইকেলে ফেরার সময় বৈকালী এলাকায় দুর্বৃত্তরা উদয় শংকর বিশ্বাসকে (৪৩) গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত সোমবার রাতে নিহত ব্যক্তির মা ছবি রানী বিশ্বাস বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে চারজনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচাকড়ি গ্রামের পবিত্র বিশ্বাসকে (৪৫) প্রধান আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া মামলায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করা হয়েছে। তবে তাঁদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।
টেকারঘাট বালিকা বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন, বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে তিনজনকে নিয়োগ এবং স্থানীয় একটি মাছের ঘের নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে তাঁর ছেলে উদয় শংকর বিশ্বাসকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বলে বাদী মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন।
উদয় শংকর বিশ্বাস নেহালপুর ইউনিয়নের পাঁচাকড়ি গ্রামের রণজিৎ বিশ্বাসের ছেলে। তিনি ওই ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি পদে ছিলেন। পাশাপাশি উপজেলার নেহালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সংস্কৃতি বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক, টেকারঘাট বালিকা বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি এবং পাঁচাকড়ি গ্রামের বৈকালী সর্বজনীন পূজামণ্ডপের সভাপতি ছিলেন।
পুলিশ জানিয়েছে, আসামিদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা হলেন পাঁচাকড়ি গ্রামের পরিতোষ বিশ্বাস (৪৫) ও উত্তম দাস (৩৪)। গতকাল মঙ্গলবার ভোরে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এজাহারভুক্ত অপর দুই আসামি পবিত্র বিশ্বাস (৪৫) ও সুভাষ বিশ্বাস (৫৫) পলাতক রয়েছেন। পবিত্র বিশ্বাস নিহত উদয় শংকর বিশ্বাসের চাচাতো ভাই; আর সুভাষ বিশ্বাস প্রতিবেশী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেকারঘাট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের সভাপতি ছিলেন পবিত্র বিশ্বাস। তিনি দায়িত্বে থাকাকালে বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির তিনটি পদে কর্মচারী নিয়োগের উদ্যোগ নেন। চাকরি দেওয়ার কথা বলে তিনি একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা নিয়েছেন বলে ওই সময় অভিযোগ পাওয়া গেছে। কিন্তু তিনি নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। এরপর বিরোধের কারণে বিদ্যালয়ের পরিচালনা পর্ষদের নিয়মিত কমিটি করা যায়নি। এ অবস্থায় পরপর দুই দফা অ্যাডহক কমিটি করা হয়। কমিটির সভাপতি ছিলেন বিকাশ কান্তি বিশ্বাস। এ সময় কমিটি গঠনের লক্ষ্যে অভিভাবক সদস্যপদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে পবিত্র বিশ্বাস ও উদয় শংকর বিশ্বাস পৃথক প্যানেল দেন। এ নির্বাচনে উদয় শংকর বিশ্বাসের প্যানেল জয়লাভ করে। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি নির্বাচনের সময় প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য উপস্থিত না হওয়ায় সভাপতি নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। এ অবস্থায় আবার অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়। অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত হন উদয় শংকর বিশ্বাস। অভিভাবক সদস্যপদে আবার নির্বাচন হয়। নির্বাচনে পবিত্র বিশ্বাসের প্যানেলকে হারিয়ে উদয় শংকর বিশ্বাসের প্যানেল জয়লাভ করে। সদস্যদের ভোটে সভাপতি নির্বাচিত হন উদয় শংকর বিশ্বাস। এরপর বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে তিনজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। কয়েক দিন আগে তাঁরা যোগদান করেন। ওই নিয়োগে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। এই নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ না হতেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীর আরও দুটি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। গতকাল মঙ্গলবার ছিল আবেদনের শেষ তারিখ।
এ ছাড়া পাঁচাকড়ি গ্রামের বিলে ১১০ বিঘা জমির একটি মাছের ঘের রয়েছে। পবিত্র বিশ্বাস গ্রামের প্রায় ২০০ লোকের কাছ থেকে ঘেরের জমি বন্ধক (হারি) নিয়ে চার বছর ধরে মাছ চাষ করছিলেন। কিন্তু তিনি ঠিকমতো বন্ধকির বার্ষিক নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করেননি। এ নিয়ে পবিত্র বিশ্বাসের সঙ্গে জমিদাতাদের দ্বন্দ্ব হয়। পরে জমিদাতারা তাঁর কাছ থেকে মাছের ঘেরটির দখল নিয়ে নেন। উদয় শংকর বিশ্বাস জমিদাতাদের পক্ষে ছিলেন। এ জন্য উদয় শংকর বিশ্বাসের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন পবিত্র বিশ্বাস।
মনিরামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মো. মনিরুজ্জামান বলেন, উদয় শংকর বিশ্বাস হত্যার ঘটনায় তদন্ত চলছে। মাছের ঘের নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। বিদ্যালয়ের সাতটি পদে নিয়োগেরও ঘটনা রয়েছে। এই দুটি ঘটনা সামনে নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে বিদ্যালয়ের সাতটি পদে নিয়োগের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটার আশঙ্কা বেশি। তিনি বলেন, দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের রিমান্ডের জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর হলে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। এ ছাড়া আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য জোর অভিযান চালানো হচ্ছে। তিনি আশা করছেন, খুব দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হবে।