‘ভাত খাইয়া দুপুরে বাবা-পুত তিনজন বিছনায় শুইয়্যা আছিলাম। ছুটু পুত ইমরান দোকান থেইক্যা ঠান্ডা (কোমল পানীয়) খাইয়্যা পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আইয়্যা পড়ব কইয়্যা বাসার বাইরে গেছে। দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া ঠান্ডা খাওনের সময় পুতের পিঠে গুলি লাগছে। আধা ঘণ্টা পার হইয়্যা গেছে। কিন্তু আমার পুত বাসায় আয়ে নাই। পরে নিচে গিয়া রাস্তায় আমি একদিকে, পুলার মা আরেক দিকে খুঁজা শুরু করছি। মুবাইলে ছবি দেহাইয়্যা মানুষরে জিগাইছি। কয়েকজন কইল গুলি নাকি লাগছে, গাড়িতে তুইল্যা হাসপাতালে নিয়া গেছে। বিকালে হাসপাতাল থেইক্যা কইছে, আমার পুত মারা গেছে। আমার পুত আর বাসায় আইত পারল না।’
কথাগুলো বলছিলেন ২১ জুলাই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ সাহেবপাড়া এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত মোনায়েল আহমেদ ইমরান ওরফে আসাদের (১৫) বাবা সোয়াব মিয়া। ইমরান হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার জিরুন্ডা মানপুর তোফাইলিয়া সিনিয়র মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল। লাখাইয়ে সে নানিবাড়িতে থেকে লেখাপড়া করত। তার বাবা-মা ও বড় ভাই তোফায়েল আহমেদ সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ সাহেবপাড়া এলাকায় একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। বাবা সোয়াব মিয়া ঢাকার বেগমবাজার ও চকবাজারে ফেরি করে পুরাতন কাপড়ের বিনিময়ে থালা-বাসন-কলসহ গৃহস্থালির মালামাল বিক্রি করেন। মা ইয়াসমিন আক্তার গৃহিণী এবং এলাকায় ছাত্রছাত্রী পড়ান। এভাবেই চলে তাঁদের সংসার। ঘটনার ১৫-২০ দিন আগে ইমরান মাদ্রাসা থেকে সিদ্ধিরগঞ্জের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল।
সোয়াব মিয়ার গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের গোয়ালনগর ইউনিয়নের রামপুর গ্রামে। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ও ইমরানের মাদ্রাসা এই গ্রামের কাছেই (পার্শ্ববর্তী উপজেলা)। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ইমরান সবার ছোট ছিল। ২২ জুলাই সন্ধ্যায় তাকে রামপুর গ্রামে দাফন করা হয়েছে।
রোববার দুপুরে নাসিরনগরের রামপুর গ্রামে গিয়ে ইমরানের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ইমরানের পিঠে গুলি লাগে, বুক ছেদ করে গুলি বের হয়। যখন গ্রামে আনা হয়, লাশের বুক কাপড় ও তুলা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল।
সোয়াব মিয়া বলেন, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ছেলে মাকে বলেছিল, ‘আম্মু কত দিন বন্দী রাখবেন। তিন দিন ধরে বাসায় বন্দী। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঠান্ডা খেয়ে চলে আসব।’ বাসা থেকে বের হওয়ার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘গুলি লাগলে “মা গো” করে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পড়ে যায় আমার ছেলে। সাহেবপাড়ার রাস্তার মোড়ে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। ওখানে গিয়ে ঘটনা শুনি। ২১ জুলাই বেলা তিনটার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়ে জানতে পারি, ছেলে মারা গেছে। কিন্তু তখন ছেলের লাশ দেখতে পারি নাই। পরদিন ১২টার পর ছেলের লাশ পেয়েছি।’
সোয়াব মিয়া বলেন, ‘গাড়িতে তোলার সময় ছেলে স্থানীয় লোকজনকে বলেছিল, দক্ষিণ সাহেবপাড়ায় আমার মা-বাবা থাকে। আমার ছবি তুলে তাঁদের দেখান।’ তিনি ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন, ‘ছেলে বলত, আপনি পরিশ্রম করতেছেন। আপনাকে আর কাজ করতে দিমু না। ছেলে মারা গেছে সাত দিন হলো। মুখ দিয়ে পেটে কোনো খাবার যায় না। কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে।’
ইমরানের মা ইয়াসমিন আক্তার এ সময় ওই বাড়িতে ছিলেন না। ইমরানের দাদা রমিজ আলী বলেন, ‘আমার নাতি গুলিতে মইরা গেছে। অত অল্প বয়সে আমরার আগে দুনিয়া ছাইড়া গেছে গা। কার কাছে এই বিচার দিমু?’
পরিবারের সদস্যরা জানান, ১৮ জুলাই রাত থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা। ২১ জুলাই দুপুর থেকে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল ও সাহেবপাড়া এলাকায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষ চলছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে ব্যাপক কাঁদানে গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। এমন সময় বাসার সামনেই সাহেবপাড়া বাজারের একটি দোকানে কোমল পানীয় পান করছিল ইমরান। এ সময় পেছন থেকে পিঠে একটি গুলি লাগলে ছিটকে পড়ে ইমরান।
নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটি মাদ্রাসায় পড়ত। মা-বাবার কাছে বেড়াতে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছিল। সেখানেই গুলিবিদ্ধ হয়েছে। পরে তার লাশ গ্রামে এনে দাফন করা হয়। দাফনের পর তার মৃত্যুর বিষয়টি বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি।’