মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে ওই সাফারি পার্ক নির্মাণ করতে চায় বন অধিদপ্তর।
সংরক্ষিত বনে স্থাপনা নির্মাণ তো দূরে থাক, প্রবেশ করতেও বন বিভাগের অনুমতি লাগে। কিন্তু মৌলভীবাজারের জুড়ীর সংরক্ষিত বন লাঠিটিলায় এক হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে সাফারি পার্ক নির্মাণ করতে চায় বন বিভাগ।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ভেঙে পাহাড় ও গাছ কেটে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নিজের নির্বাচনী এলাকায় (মৌলভীবাজার-১: বড়লেখা-জুড়ী) ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গাজুড়ে এই সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। হেলিপ্যাড নির্মাণের কথাও বলা হয়েছে প্রকল্প প্রস্তাবে। এরই মধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের খরচ বাবদ ৩৮২ কোটি টাকা চেয়েছে বন বিভাগ। অবশ্য আইন না মানা, বাড়তি ব্যয়সহ নানা অসংগতির বিষয় উল্লেখ করে গত ৩ সেপ্টেম্বর প্রকল্পটি অনুমোদন না করে ফেরত পাঠিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের আপত্তির জবাব দিয়ে ১ অক্টোবর পুনরায় প্রকল্প প্রস্তাবটি বন বিভাগ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, মন্ত্রণালয় তা চূড়ান্ত করে পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য পাঠাবে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত পাঠানো হয়নি।
সাফারি পার্কে বন্য প্রাণী উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। পর্যটকেরা নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে ওই পার্ক পরিদর্শন করতে পারেন। এখন দেশে গাজীপুর ও কক্সবাজারে দুটি সাফারি পার্ক রয়েছে। আরেকটি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সংরক্ষিত বন লাঠিটিলায়।
লাঠিটিলা বনটি মৌলভীবাজারের জুড়ী-লাঠিটিলা সড়কের এক পাশে। ১৯২০ সালে একে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। জেলাটিতে বর্শিজোড়া ইকোপার্ক, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক, মাধবকুণ্ড লেক, বাইক্কার বিলসহ বেশ কিছু পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। বছরে প্রায় পাঁচ লাখ পর্যটক সেখানে যান। পর্যটকদের জন্য হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রাস্তাসহ নানা অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। এর ফলে এসব বনভূমি ও জলাভূমির জীববৈচিত্র্য হুমকিতে আছে বলে সরকারি-বেসরকারি নানা গবেষণায় উঠে এসেছে। এর মধ্যে একমাত্র লাঠিটিলা বনভূমিটি সংরক্ষিত ঘোষণা করায় অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) বেশ কিছু সংগঠন লাঠিটিলা বনে সাফারি পার্ক প্রকল্পটিকে বন ধ্বংসের আয়োজন বলে উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে।
লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই একটি সংরক্ষিত বনের চরিত্র পরিবর্তন করে অন্য কিছু নির্মাণ করা যাবে না। দেশের আইনও তা সমর্থন করে না।সুলতানা কামাল, সাবেক সভাপতি, বাপা
বাপার সাবেক সভাপতি সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে সাফারি পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনা বাতিল করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই একটি সংরক্ষিত বনের চরিত্র পরিবর্তন করে অন্য কিছু নির্মাণ করা যাবে না। দেশের আইনও তা সমর্থন করে না।’ তিনি বলেন, ‘লাঠিটিলা বনে সাফারি পার্ক করার উদ্যোগের পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁদের পরিচয় সামনে আসা উচিত। আমাদের করের পয়সায় এ রকম পরিবেশবিধ্বংসী প্রকল্প নির্মাণ করার তীব্র প্রতিবাদ জানাই।’
তবে পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ আমলে নিতে চান না পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘লাঠিটিলা বনের বড় অংশের ভেতরে স্থানীয় অনেক ব্যক্তি দখল করে বসবাস করছেন। দখলদারদের সরিয়ে বনটিকে যাতে আরও ভালোমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়, সে জন্য সাফারি পার্কটি নির্মাণ করতে চাচ্ছি।’ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে যেসব আপত্তি তোলা হয়েছে, তার উত্তর দেওয়া হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই পার্ক হলে স্থানীয় এলাকার উন্নতি হবে।
সাফারি পার্ক প্রকল্পটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। গত ৩ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি (জুলাই ২০২৩-জুন ২০২৮) ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক’ প্রকল্পের মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় প্রকল্পটি নিয়ে নানা অসংগতি ও আপত্তির বিষয় উঠে আসে। এরপর প্রকল্পটি অনুমোদন না করে ফেরত পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে বন অধিদপ্তরের উন্নয়ন পরিকল্পনা ইউনিটের দায়িত্বে থাকা সহকারী প্রধান বন সংরক্ষক মরিয়ম আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাফারি পার্ক নির্মাণ বিষয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে যেসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তার ব্যাখ্যা আমরা তৈরি করেছি। ১ অক্টোবর তা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে তা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কাছে চূড়ান্ত করে পাঠানো হবে।’
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা সূত্রে জানা গেছে, পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, সাফারি পার্ক নির্মাণ প্রকল্পটি ‘কমলা’ শ্রেণির। এ ধরনের প্রকল্প অনুমোদনের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র লাগে। তবে বন বিভাগ বলছে, প্রকল্পটি সবুজ শ্রেণির। তাই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র লাগবে না।
পরিকল্পনা কমিশনের মতে, এ প্রকল্পের আওতায় পার্কে বেশ কয়েকটি শ্রেণিতে সড়ক নির্মাণ করা হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় বলা আছে, কোথাও ৫ থেকে ১০ কিলোমিটার পর্যন্ত সড়ক নির্মিত হলে সেটি কমলা শ্রেণির প্রকল্প। তা ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় সরকারঘোষিত বনভূমি এলাকায় প্রকল্পের স্থান নির্বাচন পরিহারের কথা বলা হয়েছে। অথচ প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে জুড়ী রেঞ্জের লাঠিটিলা বিটের চিরসবুজ বনে।
লাঠিটিলা বনের মধ্যে এ ধরনের সাফারি পার্ক নির্মিত হবে দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য আত্মঘাতী ও সর্বনাশা প্রকল্প।রেজা খান, বন্য প্রাণী ও পরিবেশবিশেষজ্ঞ
প্রকল্পের আওতায় পাহাড় কাটা, পরামর্শক ও তদারকি বাবদ বাড়তি ব্যয়, জনবল প্রস্তাবসহ বেশ কিছু অসংগতিও তুলে ধরে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ১৭১ জন জনবল চেয়েছে বন বিভাগ। এ জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৫ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রকল্পের পরামর্শক বাবদ ১৫ কোটি ও নকশা তদারকির জন্য প্রায় ৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ওই কাজ করানোর কথা প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের কাজ করার জন্য বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর রয়েছে। ওই কাজে গণপূর্তকে নিয়োজিত করার পরামর্শ দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে উপস্থিত অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটি সরকারি টাকায় বাস্তবায়িত হবে। তাই এখান থেকে ব্যক্তি পরামর্শকের জন্য ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব বাদ দেওয়া যৌক্তিক হবে। এ ছাড়া প্রস্তাবে একজন প্রকল্প পরিচালকসহ পাঁচজন কর্মকর্তাকে প্রেষণে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাঁদের জন্য বেতন বরাদ্দ রাখা হয়নি। এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এ প্রকল্পের আওতায় ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘স্কাই ওয়াক’ বানানোর প্রস্তাব দিয়েছে বন বিভাগ। স্কাই ওয়াক হচ্ছে কাচের তৈরি লিফট ও সিঁড়ি। কাচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে পর্যটকেরা নিচে বন্য প্রাণী দেখবেন। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, এ প্রস্তাব বাদ দিতে হবে।
সংরক্ষিত লাঠিটিলা বনে বন বিভাগ প্রায় ৬০ লাখ টাকা খরচ করে হেলিপ্যাড বানাতে চায়। ৬ মিটার প্রশস্ত পাকা সড়কও নির্মাণ করতে চায় বন বিভাগ। তাতে ব্যয় হবে ৭ কোটি টাকা। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, সাফারি পার্কে পাকা সড়ক নির্মাণ করলে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। হেলিপ্যাড নির্মাণ নিয়েও আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
প্রকল্পের আওতায় ১৩টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব নিয়ে আপত্তি তুলে ১০টি গাড়ি কেনার সুপারিশ করেছে পরিকল্পনা কমিশন। প্রকল্পে কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বাবদ রাখা হয়েছে ১ কোটি টাকা। এ নিয়েও আপত্তি উঠেছে।
নথি ঘেঁটে দেখা যায়, এ প্রকল্পের আওতায় ৩০ কোটি টাকায় বন্য প্রাণী কিনতে চায় বন বিভাগ। তালিকায় আছে, এশিয়ার বিপন্ন ও বিরল প্রাণী সিংহ, বাঘ, হাতি, নীলগাই, প্যারা হরিণ, মায়া হরিণ, বারো শিঙ্গা, গন্ডার, লজ্জাবতী বানর ও চিতা। আরও আছে আফ্রিকান জিরাফ, জেব্রা ও জলহস্তী। কেনা হবে সামুদ্রিক অ্যাকুয়ারিয়ামের জন্য মাছ, কচ্ছপ, অজগর, কুমির, ঘড়িয়াল ও গুইসাপ। এসব প্রাণী কিনতে কেন ৩০ কোটি টাকা খরচ হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
পরিকল্পনা কমিশন বলছে, গাজীপুর ও কক্সবাজারে দুটি সাফারি পার্কের নির্মাণকাজ এখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। এর মধ্যেই মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় ৫ হাজার ৬৩১ একর এলাকাজুড়ে আরেকটি সাফারি পার্ক করার যৌক্তিকতা প্রশ্নসাপেক্ষ।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সাফারি পার্ক নিয়ে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। বন বিভাগকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে এখন দুটি সাফারি পার্ক আছে। আরেকটি সাফারি পার্ক কতটা জরুরি, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে।
লাঠিটিলা সংরক্ষিত বনে এখনো আছে মায়া হরিণ, বুনো শূকর, উল্লুক, উল্টোলেজি বানরসহ নানা জাতের বিরল ও বিপন্ন প্রাণী। এই বনে আছে ক্ষুদ্র নখযুক্ত উদ্বিড়াল। সুন্দরবন ছাড়া আর কোথাও এদের থাকার নজির নেই। দেশের অন্যতম ক্রান্তীয় চিরসবুজ ও জীববৈচিত্র্যপূর্ণ এই বনভূমি তেলসুর, বৈলাম, চন্দন, উদালের মতো বিরল প্রজাতির বৃক্ষের আধারও।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের বন ও পরিবেশব্যবস্থা এমনিতেই হুমকির মুখে আছে। দেশে যতটুকু সংরক্ষিত বন টিকে আছে, তার পুরোটা সংরক্ষণ করতে হবে; বরং আরও নতুন নতুন বনভূমি সৃজন করতে হবে। ফলে সংরক্ষিত তো বটেই, যেকোনো বনের মধ্যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়া কীভাবে বন রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তজুড়ে থাকা পাথারিয়া পাহাড়ের একটি অংশ লাঠিটিলা বনাঞ্চল। লাঠিটিলার ২০ কিলোমিটার দক্ষিণে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক ও ৫০ কিলোমিটার উত্তরে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। সেখানে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের বসবাস। ব্রিটিশ আমলে পাথারিয়া পাহাড়ের বেশ সুনাম ছিল।
বন্য প্রাণী ও পরিবেশবিশেষজ্ঞ রেজা খান প্রথম আলোকে বলেন, লাঠিটিলা বনের মধ্যে এ ধরনের সাফারি পার্ক নির্মিত হবে দেশের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য আত্মঘাতী ও সর্বনাশা প্রকল্প। জনগণের টাকায় জনগণের প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তা না করে এ ধরনের সমৃদ্ধ বনকে সাফারি পার্ক বানানোর নামে ধ্বংস করার তৎপরতা থেকে সরকারের সরে আসা উচিত।