বগুড়ার শেরপুর

মিষ্টি কোলাহলে মুখর রামনগর 

শামুকখোল পাখির কলকাকলিতে মুখর রামনগর গ্রাম। বগুড়ার শেরপুরের গাড়িদহ ইউনিয়নে
 ছবি: প্রথম আলো

গ্রামে ঢোকার আগেই কানে আসবে পাখির কিচিরমিচির শব্দ। চোখে পড়বে গাছে গাছে শামুকখোল পাখির আনাগোনা। গাছের ডালে ডালে পাখির বাসা দেখলে মনে হবে, পাখিগুলো যেন সেখানকার বাসিন্দা হয়ে গেছে। এ চিত্র বগুড়ার শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের।

উপজেলা দশমাইল বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে গাড়িদহ ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের করতোয়া নদীর তীরে এই গ্রাম। রামনগর গ্রামের পাশ দিয়ে খামারকান্দি ইউনিয়নে যাওয়ার রাস্তা। পথচারী সাইফুল ইসলাম ও আমজাদ হোসেন বলেন, তাঁরা এ সড়ক দিয়ে নিয়মিত চলাচল করেন। সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় এই পাখির কিচিরমিচির শব্দে মনটা ভরে যায়। তাড়া না থাকলে তাঁরা কিছুটা সময় এখানে দাঁড়ান।

গ্রামের বাসিন্দা আবুল খায়ের বলেন, শীতের চার-পাঁচ মাস ছাড়া বছরের বাকি সময় এখানে এই শামুকখোল পাখি থাকে।

স্থানীয় লোকজন বলেন, মা পাখিরা বাসায় বাচ্চা দেখাশোনা করে। আর দিনের একটা অংশ বাবা পাখিরা ব্যস্ত থাকে খাবার সংগ্রহে। এরা পাশের করতোয়া নদী, ধানখেতসহ আশপাশের বিলে পানির ধারে বা অগভীর পানিতে হেঁটে হেঁটে কাদায় ঠোঁট ঢুকিয়ে খাবার খুঁজে বেড়ায়। এদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে শামুক, ঝিনুক। সচরাচর পানির নিচে শামুকের খোলস ভেঙে এরা পানির ওপর মাথা তুলে শামুকের মাংস গিলে খায়।

গ্রামের বাসিন্দারা বলেন, রামনগরে পাখিগুলো ২০১৪ সাল থেকে আসছে। এপ্রিলের শেষ দিকে অথবা মে মাসের শুরুতে পাখিগুলো এলাকায় আসে। এ সময় গাছ পছন্দ করে বাসা বানানোর কাজ শুরু করে। সাধারণত গাছের ছোট ডালপালা দিয়ে বড় মাচার মতো বাসা বানায় পাখিগুলো। বাসা বানাতে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। জুন, জুলাই ও আগস্টে এই পাখির প্রজনন সময়। শামুকখোল দুই থেকে পাঁচটি ডিম দিয়ে থাকে। স্ত্রী ও পুরুষ পাখি উভয়েই ডিমে তা দিয়ে থাকে। ২৫ থেকে ৪০ দিন পর ডিম থেকে বাচ্চা হয়ে থাকে। মা–বাবা খাদ্যের জোগানের ওপর নির্ভর করে বাচ্চাগুলো ৫৫ থেকে ৭০ দিন পর উড়তে শেখে।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই পাখিগুলো সংরক্ষণে বন বিভাগের পাশাপাশি কাজ করছে দুটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ২০১৬ সাল থেকে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের পরিবেশবাদী সংগঠন ‘তীর’ ও ২০২০ সাল থেকে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী পরিবেশবাদী সংগঠন ‘পরিবেশ প্রতিরক্ষা সংস্থা’ কাজ করে যাচ্ছে।

পরিবেশ প্রতিরক্ষা সংস্থার সভাপতি ও পাখি–গবেষক সোহাগ রায় বলেন, এ বছর রামনগর গ্রামে আট প্রজাতির শামুকখোল পাখি এসেছে। ৩৬টি গাছে ৫০০টির মতো শামুকখোল পাখির বাসা রয়েছে। সব মিলিয়ে দেড় থেকে দুই হাজার পাখি থাকতে পারে। শামুকখোল ছাড়াও কলোনিতে দেশি ১৫ থেকে ২০ প্রজাতির পাখি রয়েছে। গ্রামের জলপাই, পিতরাজ, কাঁঠাল, মেহগনি, পিটুলি, আম, শিমুলগাছ ও বাঁশঝাড়ে রয়েছে এসব পাখির বাসা। চলতি বছরে ১৪ আগস্ট ও ৩ সেপ্টেম্বর প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়ের কারণে শামুকখোল পাখির বাসা ভেঙে অন্তত ২০০টি বাচ্চা মারা গেছে। এ ছাড়া কিছু অসুস্থ পাখি উদ্ধার করে চিকিৎসা ও পরিচর্যার পর অবমুক্ত করা হয়েছে। 

সোহাগ আরও বলেন, অদ্ভুত ঠোঁটের জন্য সহজে অন্যান্য পাখি থেকে একে আলাদা করা যায়। প্রজননের আগে প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী পাখির পায়ের পাতা ও দেহের রং সাদা এবং কালো অংশ তুলনামূলক উজ্জ্বল ও আকর্ষণীয় হয়। প্রজনন ছাড়া দেহ ধূসর সাদা এবং পা অনুজ্জ্বল পাটকিলে বর্ণ ধারণ করে। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী আইনে প্রজাতিটি সংরক্ষিত।

গাড়িদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তবিবর রহমান বলেন, গ্রামবাসীসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা পাখিগুলো রক্ষায় নজরদারি করে থাকেন। এ কারণে কোনো পাখিশিকারি ওই গ্রামে যেতে পারে না।

উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. রায়হান বলেন, উপজেলার প্রাণিসম্পদ দপ্তর কয়েক বছর ধরে শেরপুরের কিছু স্বেচ্ছাসেবীর সংগ্রহ করা অসুস্থ পাখি চিকিৎসার জন্য তাঁদের কাছে নিয়ে আসছে। এ ছাড়া অন্য বন্য প্রাণীর চিকিৎসা উপজেলার প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে নিয়মিত দেওয়া হয়।