দ্বিতীয় ধাপে গতকাল মঙ্গলবার ভোলার তিনটি উপজেলা ভোলা সদর, দৌলতখান ও বোরহানউদ্দিন উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে ভোটের বেসরকারি ফলাফল ঘোষণার পর ভোলা সদর ও দৌলতখান উপজেলায় বেশ কয়েকটি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। মারধর, ভাঙচুর, পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনায় কমপক্ষে পাঁচজন আহত হয়েছেন। আহত ব্যক্তিরা স্থানীয়ভাবে ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
ভোলা সদরে মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী মো. ইউনুছ মিঞা ৭১ হাজার ১৫৫ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আনারস প্রতীকের প্রার্থী মোশারেফ হোসেন ৪০ হাজার ৮৭ ভোট পেয়েছেন। মোশারেফ হোসেন উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। ভোটের পর এই প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়েছে।
দৌলতখানে কাপ-পিরিচ প্রতীকের প্রার্থী ও উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান মো. মনজুর আলম খান ১৪ হাজার ১৭২ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন মোটরসাইকেল প্রতীকের প্রার্থী উত্তর জয়নগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ইয়াছির লিটন। তিনি ১২ হাজার ৩২১ ভোট পেয়েছেন। এ ছাড়া হেলিকপ্টার প্রতীকের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মামুন রশিদ বাবুল চৌধুরী ১১ হাজার ৮৯৭ ভোট পেয়ে তৃতীয় এবং আনারস প্রতীকের প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মৃধা ১১ হাজার ৮৫৪ ভোট পেয়ে চতুর্থ হয়েছেন। আনোয়ার হোসেন মৃধা দৌলতখান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। ভোটের পর তাঁর সমর্থকদের সঙ্গে বিজয়ী প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়েছে।
এ ছাড়া বোরহানউদ্দিনে আনারস প্রতীকের প্রার্থী মো. জাফর উল্লাহ ২৯ হাজার ৭১৬ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এবং ভোলা-২ আসনের সংসদ সদস্য আলী আজম মুকুলের ভগ্নিপতি। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী ও বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. আবুল কালাম ১৯ হাজার ১৭ ভোট পেয়েছেন।
আমরা প্রার্থীদের ডেকে বলেছি তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের শান্ত থাকতে। যেন আর কোনো ঘটনা না ঘটে। অন্যদিকে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের থানায় অভিযোগ দায়ের করতে বলেছি।রিপন চন্দ্র সরকার, সহকারী পুলিশ সুপার, ভোলা সদর সার্কেল
ভোলা সদরের শিবপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. সবুজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাবা মো. হাদীসুর রহমান (৫০) আনারস প্রতীকের সমর্থন করায় প্রতিবেশী মোটরসাইকেল প্রতীকের সমর্থক মো. মনির মাঝি (৫২) হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। কারণ, তাঁদের সঙ্গে আমাদের পূর্বশত্রুতা ছিল। গতকাল মোটরসাইকেলের প্রার্থী চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর মনির মাঝি রাতে লোকজনসহ বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যান। পরে আজ বুধবার বেলা ১১টার দিকে মনির মাঝির নেতৃত্বে এক দল লোক আমাদের বাড়িতে এসে পানির পাইপ, ঘরের বেড়া ভাঙচুর করেন। এ সময় আমার বাবা হাদীসুর রহমান, ছোট ভাই মো. শরীফকে (২৪) মারধর করেন। তাঁদেরকে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন ও সাংবাদিকেরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।’
মো. সবুজ বলেন, বিষয়টি তিনি নবনির্বাচিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. ইউনুস মিঞাকে জানিয়েছেন। কোনো প্রতিকার পাননি।
এ অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. ইউনুস মিঞা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি বিষয়টি জানেন না। জেনে ব্যবস্থা নেবেন।
আনারসের সমর্থক শিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল রাতে ফলাফল ঘোষণার পরে আজ দুপুর পর্যন্ত আনারস প্রতীকের কমপক্ষে ১০ জন সমর্থককে মোটরসাইকেল প্রতীকের সমর্থকেরা চড়-থাপ্পড়সহ ঘরবাড়ি ভাঙচুর করেছেন। অনেকে ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছেন।
অপরদিকে, দৌলতখান উপজেলায় আনারস প্রতীকের প্রার্থী পরাজিত হলেও সৈয়দপুর ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের একটি কেন্দ্রে (বিজয়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়) জয় লাভ করে। মূল নির্বাচনের ফলাফল তখনো না আসায় ওই কেন্দ্র থেকে আনারসের পক্ষে বিজয় মিছিল বের করা হয়েছিল। ওই মিছিলে থাকা ইউপি সদস্য মো. জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে আবদুল হান্নান মাঝি, আওলাদ দফাদারসহ কয়েকজন প্রতিপক্ষ কাপ-পিরিচ প্রতীকের সমর্থক জয়নব বিবি ও তাঁর মেয়েকে পিটিয়ে আহত করেন। ওই দুই নারী এখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন।
এ ছাড়া দৌলতখানের চর খলিফা ইউনিয়নের দলিলখাঁর বাজার, চরপাতা ইউনিয়নের কাজীরহাট ও ভূঁইয়ারহাটে আনারস ও কাপ-পিরিচের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে।
আনারস প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আনোয়ার হোসেন মৃধা বলেন, সৈয়দপুরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাপ-পিরিচের সমর্থক জয়নব বিবি কয়েক দফায় তাঁর কর্মীদের ওপর চড়াও হয়েছেন। এ ছাড়া দলিলখাঁর বাজারে আজ সকাল ১০টায় কাপ-পিরিচের লোকজন তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের পিটিয়েছেন। কয়েকটি দোকান ভাঙচুর করেছেন। চরপাতা ইউনিয়নের কাজীরহাটে কাপ-পিরিচ প্রতীকের সমর্থক আবুল হাসেম, সাবেক ইউপি সদস্য মো. জামাল উদ্দিন মিলে আনারসের সমর্থক আবদুল খালেক নামের একজনকে পিটিয়ে জখম করেছেন।
নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. মনজুর আলম খান (কাপ-পিরিচ প্রতীক) দলিলখাঁর বাজারে হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নির্বাচনে হেরে সবখানে আনারসের কর্মীরা তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের ওপর চড়াও হচ্ছেন। কাজীরহাটে কাপ-পিরিচের সমর্থক ব্যবসায়ী মো. নাছির মাল মোটরসাইকেলে করে যাওয়ার পথে আনারসের কর্মী নোমান পাটওয়ারী, মো. বিল্লাল, মো. রুবেল, আওলাদসহ কয়েকজন মিলে পথরোধ করে মারধর করেন। মোটরসাইকেলটিতে অগ্নিসংযোগ করতে গেলে স্থানীয় লোকজন বাধা দেন। ভূঁইয়ারহাটে কাপ-পিরিচের সমর্থক মাহিদ ভূঁইয়াকেও পিটিয়ে আহত করেন। তবে তিনি তাঁর কর্মীদের শান্ত থাকার জন্য বলেছেন।
এসব সহিংসতার ঘটনার ব্যাপারে ভোলা সদর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) রিপন চন্দ্র সরকার বলেন, ‘আমরা প্রার্থীদের ডেকে বলেছি তাঁদের কর্মী-সমর্থকদের শান্ত থাকতে। যেন আর কোনো ঘটনা না ঘটে। অন্যদিকে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাঁদের থানায় অভিযোগ দায়ের করতে বলেছি।’