জন্মের পর থেকে দুই হাত নেই সিয়াম মিয়ার (১৬)। ছোটবেলা থেকে পা দিয়ে লিখে নিজের পড়াশোনা এগিয়ে নিয়েছে। অভাবের সংসারে চতুর্থ শ্রেণিতে থাকতে একবার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। পা দিয়ে এবারের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মানবিক শাখায় জিপিএ-৩.৮৩ পেয়েছে সে।
সিয়াম জাামলপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার ডোয়াইল ইউনিয়নের উদনাপাড়া গ্রামের দিনমজুর জিন্নাহ মিয়ার ছেলে। চাপার কোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মানবিক শাখা থেকে এবার সে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সিয়াম সবার ছোট। বড় বোন ও ভাই বিএ পাস করেছেন। বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাই চাকরিপ্রত্যাশী।
এসএসসির ফল ঘোষণার পর আজ রোববার দুপুরে সিয়ামদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সিয়ামের ফলাফলে পরিবারের সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এ কান্না খুশির! সিয়ামের পরীক্ষার ফলাফল জানতে প্রতিবেশী ও গ্রামের লোকজন ভিড় করেছে। সিয়ামের এসএসসির ফলাফলে পরিবার ও গ্রামের সবাই উচ্ছ্বসিত।
সিয়াম বলে, ‘পা দিয়ে লিখতে আমার একটু কষ্ট হইছে। কিছুক্ষণ পরপর পায়ে ব্যথা করেছে। একটু বসে থেকে আবার লেখা শুরু করছি। সাড়ে ৩ ঘণ্টার আগেই সব প্রশ্নের উত্তর লিখা শেষ করেছি। এ ফলাফলে আমি আনন্দিত হয়েছি। স্যার ও সহপাঠীদের সহযোগিতায় এ ফলাফল করা সম্ভব হয়েছে। সামনে কলেজে ভর্তি হতে পারব কি না, চিন্তায় আছি। কারও সহযোগিতা পেলে সামনে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চাই।’
পরিবারের সদস্য ও চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা বলেন, ২০০৮ সালে জোসনা বেগম-জিন্নাহ মিয়া দম্পতির ঘরে সিয়ামের জন্ম। জন্মের পর থেকেই তার দুই হাত ছিল না। ২০১৪ সালে তাকে বাড়ির পাশে উদনাপাড়া ব্র্যাকের একটি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন মা-বাবা। চতুর্থ শ্রেণিতে ওঠার পর সিয়ামের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। অভাবের সংসারে তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালাতে পারছিলেন না দিনমজুর জিন্নাহ মিয়া। এক বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকার পর ব্র্যাক স্কুলের এক শিক্ষকের প্রচেষ্টায় ২০১৮ সালে সিয়াম প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেয়। এরপর চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয় সিয়াম।
সিয়ামের বাবা জিন্নাহ মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যের বাড়িতে কাজ করে তিনটি বাচ্চাকে এ পর্যন্ত আনছি। ভিটেমাটি ছাড়া আমার আর কিছুই নেই। ছেলে আমার প্রতিবন্ধী নয়, তার ভবিষ্যৎ সোনার টুকরা। ছেলেডা পরীক্ষায় বালাভাবে পাস করছে।’
মা জোসনা বেগম বলেন, ‘অভাবের সংসারে ছেলের পড়ালেখা এক বছর বন্ধ ছিল। ছেলেডারে বালা খাওন দিতে পারি নাই। তবু রাগ করে নাই। অনেক দিন না খেয়ে স্কুলে গেছে। ছেলের পরীক্ষার ফলাফলে আমার ভালা লাগতাছে। ছেলের পরীক্ষার পাসের খবর শুনতে গ্রামবাসী বাড়িতে ভিড় করছে।’
সিয়ামের ফলে খুশি চাপারকোনা মহেশ চন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রফিকুল ইসলাম। তাঁর ভাষ্য, শারীরিক প্রতিবন্ধী হলে সিয়াম একদিন দেশের গৌরব বয়ে আনবে। তিনি জানান, বিদ্যালয় থেকে এ বছর ১৯৬ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ১৯৪ পরীক্ষার্থী পাস করেছে। জিপিএ ৫ পেয়েছে ২৪ পরীক্ষার্থী।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, কলেজে ভর্তি হতে সিয়ামকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে। সে দেশের সম্পদ। সিয়াম কষ্টে পা দিয়ে লিখে এ পর্যন্ত এসেছে। অসহায় প্রতিবন্ধী সিয়াম ও তাঁর পরিবারের সহযোগিতা করা সবার দায়িত্ব।