কক্সবাজারে তীব্র তাপদাহ পরিস্থিতি যাচ্ছে। এতে এবার কক্সবাজার উপকূলে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। আগে দৈনিক ২০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হলেও এখন হচ্ছে ৩০ হাজার মেট্রিক টনের বেশি।
তবে এ পরিস্থিতিতে চাষিরা লবণের দাম কম পাচ্ছেন। ঈদ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা হঠাৎ মণপ্রতি লবণের দাম ৩০-৪০ টাকা কমিয়ে দিয়েছেন। ঈদের কেনাকাটা ও খরচের জন্য চাষিদের টাকার প্রয়োজন হচ্ছে। কমবেশি সবাই লবণ বিক্রি করতে তৎপর। সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। এরপর যুক্ত হয়েছে টানা তাপদাহের পর কালবৈশাখী ঝড়ের আতঙ্ক। কারণ, একবার বৃষ্টি হলে অন্তত সাত দিন লবণ উৎপাদন বন্ধ থাকবে। তখন চাহিদা অনুযায়ী লবণ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। চলতি বছর দেশে লবণের জাতীয় বার্ষিক চাহিদা ধরা হয়েছে ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) কক্সবাজার লবণশিল্প উন্নয়ন প্রকল্পের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাফর ইকবাল ভূঁইয়া ঈদে লবণের দাম কমার কথা নিশ্চিত করেছেন।
কুতুবজোমের চাষি গিয়াস উদ্দিন (৪৮) ও খুরুশকুলের চাষি আহমদ হোসেন (৫৫) বলেন, গত মার্চ মাসেও প্রতি মণ লবণ ৪০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি হয়েছে। ১০ দিন আগে দাম ছিল ৩৮০ টাকা। এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা কম দামে।
চলতি বছর দেশে লবণের জাতীয় বার্ষিক চাহিদা ধরা হয়েছে ২৫ লাখ ২৮ হাজার মেট্রিক টন।
বিসিকের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে (নভেম্বর-এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচ মাস) জেলার টেকনাফ, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, মহেশখালী, চকরিয়া ও চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় ৬৬ হাজার ৪২৪ একর জমিতে লবণ উৎপাদন চলছে। এসব মাঠে লবণ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন। ৬ এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে লবণ উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ১৭ লাখ মেট্রিক টন। লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে আরও লাগবে ৮ লাখ মেট্রিক টন। অন্তত ৪০ হাজার প্রান্তিক চাষি, ১ লাখ শ্রমিকসহ জেলার অন্তত ১০ লাখ মানুষ লবণ উৎপাদন, পরিবহন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বিসিকের তথ্যমতে, গত বছর প্রতি মণ লবণের গড় মূল্য ছিল ৪৩০ টাকা, এখন গড়ে বিক্রিমূল্য ৩৭২ টাকা।
গত মঙ্গলবার দুপুরে মহেশখালীর কুতুবজোম, হোয়ানক, কক্সবাজার সদরের চৌফলদন্ডি, খুরুশকুল, পিএমখালী ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার অন্তত ২৫ হাজার একর মাঠে লবণের বাম্পার উৎপাদন হচ্ছে। মাঠের বিভিন্ন স্থানে লবণের স্তূপ দেখা গেছে। প্রতি মণ লবণ বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকায়।
সাগরদ্বীপ মহেশখালী উপজেলায় এবার ১৬ হাজার ৭১৭ একর জমিতে লবণের চাষ হচ্ছে। কুতুবদিয়া ও টেকনাফে হচ্ছে আরও ১৫ হাজার একরে। ৮০ শতাংশ চাষি ব্যক্তিমালিকানার জমি বর্গা নিয়ে লবণ উৎপাদন করছেন। গত বছর প্রতি কানি (৪০ শতক) জমির ইজারামূল্য ছিল ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এবার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। তাতে উৎপাদন খরচ বেড়েছে।
চাষিরা জানান যে তাঁরা মৌসুমের শুরু থেকেই শতভাগ মাঠে পলিথিন ব্যবহার করছেন। সমুদ্রের লোনা পানি মাঠের পলিথিনের ওপর জমিয়ে সূর্যতাপে শুকিয়ে উৎপাদিত হয় লবণ। সনাতন পদ্ধতির তুলনায় পলিথিন ব্যবহারে লবণ উৎপাদন আড়াই গুণ বেশি হয়।
মহেশখালীর চাষি হামজা মিয়া (৫৩) ও টেকনাফের চাষি সাইফুল ইসলাম (৫০) বলেন, গত কয়েক দিনে সিলেট, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিলাবৃষ্টি ও কালবৈশাখী হয়েছে। তবে এখনো কক্সবাজারে এ রকম হয়নি। এখানে তাপদাহ পরিস্থিতি যাচ্ছে। তাতে চাষিরা বেশি বেশি লবণ উৎপাদন করতে পারছেন। আগে দৈনিক ২০ হাজার মেট্রিক টন লবণ উৎপাদিত হলেও এখন হচ্ছে ৩০ হাজার টনের বেশি। তাতে ব্যবসায়ীরা পরিকল্পিতভাবে লবণের দাম মণপ্রতি ৩০-৪০ টাকা কমিয়ে দিয়েছেন। এতে চাষিরা কষ্টের মূল্য পাচ্ছেন না। এখন ঝড়-বৃষ্টি হলে লবণ উৎপাদনের পুরো কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। তখন চাষিদের সব কষ্ট বিপুল লোকসানে পরিণত হবে।
বিসিক লবণ উন্নয়ন প্রকল্পের মাঠ পরিদর্শক মো. ইদ্রিস আলী বলেন, গতকাল বুধবার জেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতি মণ লবণ ৩৫০ থেকে ৩৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ ১৫ দিন আগেও প্রতি মণ লবণ বিক্রি হয়েছিল ৪৮০ থেকে ৪৯০ টাকায়। প্রতি মণ লবণ উৎপাদনের বিপরীতে চাষিদের খরচ যাচ্ছে ২১০ টাকার মতো। প্রচণ্ড গরমে লবণের বাম্পার উৎপাদন হলেও ঈদ উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা দাম ৩০-৪০ টাকা কমিয়ে দিয়েছেন। তাতে চাষিরা হতাশ হচ্ছেন।