‘আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম স্বৈরাচার হাসিনা আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের বুকে আর একটাও যেন গুলি না চালায়। আমরা জানতাম প্রতিবাদ করলে রাজতন্ত্র আইনে আমাদের শাস্তি পেতে হবে। সেই শাস্তিকে উপেক্ষা করেই আমরা আন্দোলনে নেমেছিলাম।’
কথাগুলো বলছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ফরিদ আহমেদ ওরফে শাহীন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ করায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) সাজা পাওয়া ৫৭ বাংলাদেশির একজন তিনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচেষ্টায় সাজাপ্রাপ্তদের ক্ষমা করে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান। সাজা মওকুফ হওয়ার পর ৭ সেপ্টেম্বর রাতে প্রথম ধাপে মুক্তি পাওয়া ১৪ বাংলাদেশির সঙ্গে দেশে ফিরেছেন ফরিদ আহমেদ।
আজ শুক্রবার সকালে চৌদ্দগ্রাম পৌর এলাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ফরিদ। বিদেশের মাটিতে সাজা ও জেলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে অনেকটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ফরিদ বলেন, ‘জেলে যাওয়ার পর ভাবিনি আর কখনো স্ত্রী-সন্তানের মুখ দেখতে পাব। এটাও ভাবিনি এত দ্রুত ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হবে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি ড. ইউনূস স্যারের প্রতি। যিনি নতুন করে দ্বিতীয়বার পৃথিবীর আলো দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন।’
৪৭ বছর বয়সী ফরিদ দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। তিনি জানান, প্রায় ২০ বছর ধরে আইনকানুন মেনে সুনামের সঙ্গে দুবাইতে ব্যবসা করেন তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে গত ১৯ জুলাই দুবাইতে থাকা প্রবাসীরা ঐক্যবদ্ধভাবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল করেন। পরদিন ওই দেশের পুলিশ আন্দোলনরত বাংলাদেশিদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করে। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিদেশের মাটিতে আন্দোলনের কারণে সাজাপ্রাপ্তদের সাজা মওকুফের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়।
বন্দী জীবনের কথা উল্লেখ করে ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টনীতে ৪৫ দিনের বন্দী জীবনে দেখা হয়নি কারও সঙ্গে। দিন যতই গড়াচ্ছিল, স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের চিন্তায় ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছিল। বিদেশের কারাগার জীবনের বিভীষিকাময় দিনগুলোর স্মৃতি এখনো তাড়া করছে আমাকে। টানা ৪৫টা দিন আমার কাছে কয়েক শ বছরের মতো লেগেছিল। সময় যেন ফুরাচ্ছিল না। ভেবেছিলাম জীবনে আর দেশে ফিরতে পারব না।’
ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘জেলে বন্দী থাকা অবস্থায় হঠাৎ একদিন শুনলাম আমাদের মুক্তির বিষয়ে বাংলাদেশের সরকার আমিরাতের সাথে যোগাযোগ করছে। তখন সাথে সাথে আল্লাহর দরবারে সিজদায় পড়ে গিয়েছিলাম। তার কয়েক দিন পর শুনলাম আমিরাতের রাষ্ট্রপতি আমাদের সাধারণ ক্ষমা করে মুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। জীবনের সবচেয়ে আনন্দের খবর আমার কাছে সেটিই ছিল।’
কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিভিন্ন স্থানে গত জুলাইতে বিক্ষোভ করায় ৫৭ জন বাংলাদেশিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন দেশটির একটি আদালত। তাঁদের মধ্যে তিনজনকে যাবজ্জীবন, ৫৩ জনকে ১০ বছর এবং বাকি একজনকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুমতি ছাড়া যেকোনো ধরনের বিক্ষোভ নিষিদ্ধ।