যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরের ওজন স্কেলে (ওজন পরিমাপক যন্ত্র) ডিজিটাল কারসাজি করে শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই আমদানিকারকদের পণ্য আনার সুযোগ করে দিয়েছিল একটি চক্র। বিষয়টি জেনে বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় বেনাপোল কাস্টমস। এরপর কারসাজি বন্ধ করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এতে বন্দরের রাজস্ব আদায় বেড়ে যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে স্থলবন্দর থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১৬ কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করেছে কাস্টমস।
ওজন স্কেলের সফটওয়্যারের আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে শুল্ক ছাড়া পণ্য আনার সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বন্দরের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে। এরপর ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অন্যত্র বদলি করে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি সফটওয়্যারের ত্রুটি নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ নিয়ে গত ৩১ জানুয়ারি প্রথম আলোতে ‘বেনাপোল স্থলবন্দরে “ডিজিটাল” কারসাজি করে রাজস্ব ফাঁকি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
বেনাপোল কাস্টমস সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেনাপোল স্থলবন্দরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৫ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। বিপরীতে আদায় হয়েছে ৬ হাজার ১৬৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ১৫৮ কোটি, আদায় হয় ৪ হাজার ৬০০ কোটি ৬০ লাখ। ঘাটতি ছিল ৫৫৭ কোটি ৪০ লাখ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৫ হাজার ৯৬৬ কোটির বিপরীতে আদায় হয় ৫ হাজার ৭৮৬ কোটি ২৩ লাখ। ঘাটতি ছিল ১৭৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
বেনাপোল কাস্টমস হাউসের কমিশনার আবদুল হাকিম প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো সফটওয়্যারের ত্রুটি থাকলে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা সংরক্ষিত তথ্য থেকে তা শনাক্ত করতে পারেন এবং দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে পারেন। বেনাপোল বন্দরের সফটওয়্যারে তথ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হতো না। এতে ওজন স্কেলের ত্রুটি কাজে লাগিয়ে রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হতো। স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ ত্রুটি দূর করে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছে। আমদানি করা পণ্যের সঠিক শুল্কায়ন করা হয়েছে। মামলার কারণে বকেয়া রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। বেনাপোল বন্দরে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।
ওজন স্কেল ৩০ ফুট দীর্ঘ একটি লোহার সেতু। এর নিচে যন্ত্র থাকে। ওজন স্কেলের সঙ্গে কম্পিউটার সংযুক্ত থাকে। পাশের একটি ঘরে কম্পিউটারে ট্রাকসহ আমদানি পণ্যের ওজন পরিমাপ করা হয়। বেনাপোল স্থলবন্দরে ওজন স্কেল আছে সাতটি। এর মধ্যে ২ ও ৩ নম্বর ওজন স্কেল নষ্ট হয়ে আছে। ১ ও ৭ নম্বর ওজন স্কেল জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়। ৪, ৫ ও ৬ নম্বর ওজন স্কেলে ট্রাকসহ আমদানি করা পণ্য ওজন করা হয়।
স্থলবন্দর সূত্র জানায়, বেনাপোল বন্দরে গতি আনতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্দর অটোমেশন প্রকল্পের আওতায় একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। এ ব্যবস্থায় ওজন স্কেলে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের ওজন পরিমাপের পর গাড়ির ওজন বাদ দিয়ে পণ্যের ওজন স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার্ভারে সংরক্ষণ করা হয়। পাশাপাশি শুল্ক হিসাবের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় প্রতিবেদন হয়। ব্যবস্থাটি চালুর পরপরই কিছু ত্রুটি খুঁজে পায় বন্দর ও কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী, আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের একটি চক্র। তারা আগে পণ্য ও ট্রাকের ওজন জেনে যেত। তারা ঘোষণাবহির্ভূত পণ্যের হিসাব লুকাতে নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিত। কখনো ট্রাকের পেছনের অংশ স্কেলের বাইরে রাখত। কখনো ভারত থেকে আসা ট্রাকের সমপরিমাণ ওজনের আরেকটি ট্রাক স্কেলে রাখত। পরে ঘোষণাপত্রের সঙ্গে মিল রেখে পণ্যের ওজন দেখাত। এভাবে বাড়তি পণ্যের শুল্ক ফাঁকি দিত। কম্পিউটারাইজড স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েও চক্রটি কারসাজি করত।
বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক (ট্রাফিক) অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করিম বলেন, বন্দরের অটোমেশন সিস্টেমের বিভিন্ন সিকিউরিটি ফিচার উন্নয়ন ও হালনাগাদ করা হয়েছে। সফটওয়্যারের সঙ্গে সংযুক্ত ওজন স্কেলে পণ্যের ওজন নিরূপণে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা, নজরদারি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে। এ জন্য ২০২৩-২৪ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে।