মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে গতকাল সোমবার পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া ১৭৯ জন সীমান্তরক্ষীর (বিজিপি) পরিচয় শনাক্তের পাশাপাশি তথ্যভান্ডার তৈরির কাজ চলছে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের বিজিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর তাঁদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে জানান প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
গতকাল দুপুর থেকে রাত আটটা পর্যন্ত তিন দফায় ১৭৯ জন বিজিপি সদস্য নাইক্ষ্যংছড়ির জামছড়ি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেন। তাঁদের সবাইকে নিরস্ত্র করে হেফাজতে নেয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। প্রথমে বিজিপি সদস্যদের শূন্যরেখার কাছে একটি চা–বাগানে রাখা হয়। গভীর রাতে গাড়িতে করে ১৭৯ সদস্যকে নেওয়া হয় প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের ১১ বিজিবি ব্যাটালিয়নে। সেখানে বিজিবি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁদের রাখা হয়। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে বিজিপি সদস্যদের পরিচয় শনাক্ত ও তথ্যভান্ডার তৈরিসহ আনুষঙ্গিক কাজ শুরু হয়। তবে বিজিপি সদস্যদের সঙ্গে আসা দুই দোভাষীকে আজ মঙ্গলবার সকালে মিয়ানমারে ফেরত (পুশব্যাক) পাঠানো হয়েছে।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, ১২ দিন ধরে রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের আশপাশের কয়েকটি গ্রামে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে তুমুল সংঘর্ষে জড়ায় সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ)। কয়েক দিন ধরে শক্তি বাড়িয়েছে আরাকান আর্মি। টিকতে না পেরে মংডুর পেছনে কালাদান পাহাড়ে আত্মগোপন করেন বিজিপিসহ সরকারি লোকজন। নাইক্ষ্যংছড়িতে গতকাল আশ্রয় নেওয়া ১৭৯ জনের অধিকাংশই মংডু টাউনশিপ এলাকা থেকে আসা বিজিপি সদস্য বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আজ বিকেল চারটা পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত স্বাভাবিক আছে জানিয়ে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল নাইক্ষ্যংছড়িতে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের ১৭৯ জনকে ১১ বিজিবির ব্যাটালিয়ন–সংলগ্ন একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ চলছে বিজিবির তত্ত্বাবধানে। পাশাপাশি তাঁদের আঙুলের চাপসহ ডেটাবেজ তৈরির কাজ করা হবে। এরপর তাঁদের স্বদেশে ফেরতের প্রক্রিয়া শুরু হবে।
বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে নাইক্ষ্যংছড়ির ১১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের দায়িত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকা দিয়ে নতুন করে ১৭৯ বিজিপি সদস্য বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। সবাইকে নিরস্ত্র করা হয়েছে।
সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, গত ২ ফেব্রুয়ারি নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ শুরু হয়। এর জেরে ৪ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন বিজিপির ৩০২ সদস্যসহ ৩৩০ জন। ১৫ ফেব্রুয়ারি তাঁদের সবাইকে ফেরত পাঠানো হয়।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সীমান্তের লোকজন জানান, নাইক্ষ্যংছড়ির কোনারপাড়া, তুমব্রু, ঘুমধুম, জামছড়ির বিপরীতে রাখাইন রাজ্যের কয়েকটি পাহাড়ে গত জানুয়ারি মাসেও বিজিপির সাত-আটটি সীমান্তচৌকি ছিল। সেখানে অস্ত্রধারী বিজিপি সদস্যদের পাহারা দিতে দেখা যেত। ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এসব চৌকি দখলে নেয় আরাকান আর্মি। এপার থেকে খালি চোখে আরাকান আর্মির পাহারা দেখা যায়। এখন দক্ষিণ দিকে মংডু টাউনশিপ দখলে মরিয়া আরাকান আর্মি।
ফেব্রুয়ারি মাসে আরাকান আর্মি উত্তর রাখাইনের (নাইক্ষ্যংছড়ির বিপরীতে) তুমব্রু রাইট ও লেফটে সাতটির বেশি সীমান্তচৌকি দখল করে নেয়। ঢেঁকিবুনিয়ার সেনা ব্যারাকেও বারবার হামলা চালাচ্ছে। মংডুর দক্ষিণে রাচিডং, বুচিডং টাউনশিপের কয়েকটি চৌকিও দখলের নিয়েছে। সেখান থেকে কিছুটা দূরে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিথুয়ে (আকিয়াব) দখলের সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে আরাকান আর্মি। রাজধানী সিথুয়ের সঙ্গে মংডু টাউনশিপের সড়ক যোগাযোগ টানা এক মাস ধরে বন্ধ থাকায় সেখানে খাদ্যসামগ্রীসহ জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি তেলের সংকটে ভুগছে সেখানকার সরকারি বাহিনী। এ কারণে বাহিনীর সদস্যরা গাড়ি নিয়ে নিয়মিত টহলে যেতে পারছেন না। আকাশ থেকেও মর্টার শেল ও গ্রেনেড বোমা নিক্ষেপ কমিয়ে আনা হয়েছে।
রাখাইন পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে জানিয়ে টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে কঠোর নজরদারিতে আছে বিজিবি।