জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের আবাসিক হলগুলোয় তীব্র হয়েছে আবাসন–সংকট। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হলে অছাত্রদের অবস্থানের কারণে এ সংকট তৈরি হয়েছে। এতে নিয়মিত শিক্ষার্থীরা যেমন আসন পাচ্ছেন না, তেমনি পড়ছেন নানা সমস্যায়। বিভিন্ন সময় হলে আসন নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে তাঁদের। প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিকবার দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে। শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার পরও শিক্ষার্থীদের হলে অবস্থান, প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতা ও ছাত্ররাজনীতির প্রভাব আসন–সংকটের অন্যতম কারণ বলে দাবি করছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিভিন্ন হল সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য ৯টি হলে মোট আসনসংখ্যা ৫ হাজার ৬৪০। তবে আসনের বিপরীতে অধিকাংশ হলে প্রায় দেড় গুণ বেশি শিক্ষার্থী বসবাস করছেন। এ ছাড়া হলগুলোয় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছেন, যাঁদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের।
ছাত্র ইউনিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক আলিফ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে লাঠিয়াল হিসেবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে আসছে। যার কারণে তাঁদের যে দাবি ‘অছাত্রদের ক্যাম্পাস ছাড়া করতে হবে’ তা নোটিশ দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। সাত দিনের মধ্যে অছাত্রদের বের করে দেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি প্রশাসন দিয়েছিল, তা আড়াই মাস অতিবাহিত হওয়ার পরও কার্যকরের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং হলে হলে সেই অছাত্র ছাত্রলীগের কর্মী ও নেতারা প্রশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় গণরুমে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ ও ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেলেও তাঁদের অধিকাংশ এখনো হলে থাকছেন। এ ছাড়া ৪৫তম ব্যাচের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন শেষ হলেও তাঁরাও অনেকেই হল ছাড়েননি। হলে থাকা এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
অবৈধ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫ শতাধিক
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলে অছাত্র আছেন ৪০ থেকে ৫০ জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে দেড় শতাধিক, মীর মশাররফ হোসেন হলে শতাধিক, শহীদ সালাম-বরকত হলে ৬০ থেকে ৭০, আ ফ ম কামালউদ্দিন হলে ৫০ থেকে ৬০, মওলানা ভাসানী হলে শতাধিক, আল বেরুনী হলে ৪০ থেকে ৫০ ও শহীদ রফিক-জব্বার হলে দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী অবৈধভাবে হলে আছেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে ২১ নম্বর নতুন হলে (এখনো নামকরণ হয়নি) ছাত্র তুলে দেওয়া হয়েছে।
প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে ব্যর্থতা
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষাজীবন শেষ হয়ে গেছে, এমন শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে হল ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও তাঁরা হল ছাড়েননি। এ ব্যাপারে নোটিশেই সীমাবদ্ধ থাকে প্রশাসন। চলতি বছরের ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক নোটিশের মাধ্যমে বিভিন্ন হলে অবস্থানরত অবৈধ শিক্ষার্থীদের সাত দিনের মধ্যে হল ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে এরপর প্রশাসনের পক্ষ থেকে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, হলে অবৈধভাবে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না।
দুর্ভোগে শিক্ষার্থীরা
হলগুলোয় তীব্র আসন–সংকট থাকার কারণে চরম দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, একাধিক হলের গণরুমে আকার ভেদে ২৫ থেকে ৩৫ জন শিক্ষার্থী থাকছেন গাদাগাদি করে। এ ছাড়া দুই আসন ও চার আসনবিশিষ্ট বেশ কয়েকটি (মিনি গণরুম) কক্ষে থাকছেন ৮ থেকে ১২ জন শিক্ষার্থী। দুর্ভোগের পাশাপাশি স্বাভাবিক শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে এসব শিক্ষার্থীর।
শহীদ রফিক-জব্বার হলের দর্শন বিভাগের ৫১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী সজীব আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা হলের একটি রুমে ৪৬ জন থাকি। প্রচণ্ড গরমে রুমে থাকা মুশকিল। তা ছাড়া সব সময়ই শব্দ থাকে। দিনে–রাতে কখনোই ঘুম হয় না। ঠিকমতো পড়াশোনা করা সম্ভব হয় না।’
দাবি আদায়ে আন্দোলনই যেন ভরসা
বিভিন্ন সময় হলে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের আসন নিশ্চিত করার দাবিতে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ‘আড়াই বছরেও মেলেনি বরাদ্দকৃত সিট ও পড়ার টেবিল! কেন?’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় অবস্থান নিয়ে আন্দোলন করেন ইংরেজি বিভাগের ৪৯তম ব্যাচের শিক্ষার্থী শেখ মোহাম্মদ সিয়াম। তিনি ৯ দিন আন্দোলন করেন। পরে উপাচার্য ওই শিক্ষার্থীর সংশ্লিষ্ট হলের প্রাধ্যক্ষকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন।
এদিকে গত বুধবার রাত থেকে অছাত্রদের রুম থেকে বের করা, গণরুম বিলুপ্ত করা ও মিনি গণরুমে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের আসন নিশ্চিত করার দাবিতে অনশন শুরু করেন সামিউল ইসলাম নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। অভিযোগ উঠেছে, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সামিউলসহ প্রগতিশীল সংগঠনের শিক্ষার্থীদের মারধর করেছেন। সামিউল আজ বৃহস্পতিবার আট দিন পর অনশন ভেঙেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভাষ্য
প্রশাসনের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’–এর আওতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের জন্য ছয়টি হল নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে দুটি হলের নির্মাণকাজ শেষে শিক্ষার্থী তুলে দেওয়া হয়েছে। বাকি চারটি হলের নির্মাণকাজ শেষ হলে আবাসন–সংকট থাকবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নুরুল আলম বলেন, অছাত্রদের তালিকা তৈরি করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্মাণাধীন হলগুলোর কাজ শেষ হয়ে গেলে আবাসন–সংকটের সমাধান হয়ে যাবে।
হল কমিটির সভাপতি নাজমুল হাসান তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, অছাত্ররা যেন হলে অবস্থান না করতে পারেন, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা কাজ শুরু করেছেন। তবে এর কোনো সুনির্দিষ্ট সংখ্যা তাঁদের জানা নেই। তাঁরা আশা করছেন, দ্রুতই এ সংকট অনেকটাই সমাধান হয়ে যাবে। নির্মাণাধীন হলগুলোর কাজ শেষ হলে তখন আর কোনো সমস্যা থাকবে না। সমস্যা নিরসনে এখন শুধু সময়ের প্রয়োজন। হলে অছাত্রদের অবস্থানের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রভাবের বিষয়ে তিনি জানেন না বলে উল্লেখ করেন।