ভৈরবে দুর্ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জ পথে সাড়ে সাত ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। রেলের তিনজন বরখাস্ত।
‘বড় একটা আওয়াজ হয়। এরপর দেখি আমরা একদিকে হেইল্লা পড়তাছি। সবাই এক পাশে চাপা পড়ি। তখন আর শ্বাস নিতে পারতেছিলাম না। মনে হইতাছিল দম আটকায়া আইতাছে, অহনই মরণ হইব।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বললেন কিশোরগঞ্জের ভৈরবে ট্রেন দুর্ঘটনায় আহত রেশমা বেগম (৩৫)। দুর্ঘটনায় তাঁর এক হাত ভেঙে গেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাঁকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সাতটার দিকে কথা হয় রেশমার সঙ্গে। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী উপজেলায়। ঢাকায় মেয়ের কাছে যেতে কিশোরগঞ্জ থেকে আন্তনগর এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন। তিনি ছিলেন ট্রেনের একেবারে পেছনের কোচের আগেরটিতে।
গতকাল বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিম প্রান্তে এগারসিন্দুর ট্রেনটির পেছনের তিনটি কোচে মালবাহী একটি ট্রেন ধাক্কা দেয়। এতে যাত্রীবাহী ট্রেনের পেছনের দুটি কোচ উল্টে গিয়ে ১৮ জন নিহত ও শতাধিক আহত হন।
দুর্ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-কিশোরগঞ্জ—তিন পথে সাড়ে সাত ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এর আগে ঢাকা ও আখাউড়া থেকে উদ্ধারকারী ট্রেন গিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। ট্রেন বন্ধ থাকায় পথে পথে আটকে থাকে বেশ কিছু যাত্রীবাহী ট্রেন। এসব ট্রেনের যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, দুর্ঘটনা ঘটেছে ভৈরব স্টেশনের বাইরে, যেখানে একাধিক লাইনের জোড়া রয়েছে। এখানে ট্রেন এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যায়। ফলে দুটি ট্রেনের মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হওয়ার আশঙ্কাও ছিল। এতে আরও বড় বিপর্যয় হতে পারত।
রেল পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সূত্র বলছে, দুটি ট্রেন একই লাইনে বা একাধিক লাইনের মোড়ে আসার সুযোগই নেই। এ ক্ষেত্রে স্টেশনমাস্টার মালবাহী ট্রেনটিকে আউটারে থামার সংকেত না দিলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কোনো স্টেশনের আউটার হচ্ছে ট্রেনগুলোকে অপেক্ষায় রাখার জায়গা। অন্য ট্রেনকে জায়গা দিতে আউটার এলাকায় ট্রেন থামার লাল বাতির সংকেত (সিগন্যাল) আগেই জ্বালিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে।
অন্যদিকে থামার সংকেতবাতি দেওয়ার পরও চালক তা না মানলে দুর্ঘটনা ঘটে। প্রাথমিকভাবে রেল কর্তৃপক্ষ দেখেছে, মালবাহী ট্রেনটির চালক থামার সংকেত উপেক্ষা করে দ্রুত ট্রেনটি চালিয়ে এসে এগারসিন্দুর ট্রেনটিকে ধাক্কা দেন।
জানতে চাইলে রেলের পূর্বাঞ্চলের ব্যবস্থাপকের দায়িত্বে থাকা (জিএম) নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, চালক সংকেত না মেনেই চলে এসেছেন বলে মনে হয়েছে। এরপরও দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। প্রতিবেদন পেলে পুরো চিত্র পাওয়া যাবে। এরপর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মালবাহী ট্রেনের চালক, সহকারী চালক ও পরিচালককে (গার্ড) সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
রেলওয়ের কর্মকর্তা ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনামতে, এগারসিন্দুর ট্রেনটি ভৈরব রেলস্টেশন থেকে ঢাকার পথে আসছিল। আর মালবাহী ট্রেনটি ভৈরব স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। দুর্ঘটনাটির সময় এগারসিন্দুর ট্রেনটি এক লাইন থেকে অন্য লাইনে যাচ্ছিল। এগারসিন্দুর ট্রেনটি লাইন পরিবর্তনের জায়গা অতিক্রম করে ১১টি কোচ পার হয়ে যায়। কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আসা মালবাহী ট্রেনটি এগারসিন্দুরের শেষ তিন কোচে আঘাত করে।
রেলের কর্মকর্তারা বলছেন, যদি চালক সংকেত অমান্য করে চলে আসেন, সে ক্ষেত্রে হেমন্তের বিকেলে সবকিছু দূর থেকেই পরিষ্কার দেখার কথা। অর্থাৎ একই লাইনে অন্য একটি ট্রেন আছে দেখে গতি কমিয়ে থামানো যেত। সেটা কেন করা হয়নি, তা–ও একটি প্রশ্ন।
দুর্ঘটনার সময়ের দুটি ভিডিও পেয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এতে দেখা যায়, সামনে ট্রেন দেখে জোরে হর্ন বাজাচ্ছিল মালবাহী ট্রেনটি। তখনো এর গতি ছিল বেশি। কিন্তু পরে একেবারে যাত্রীবাহী ট্রেনে ধাক্কা দেওয়ার আগে কিছুটা গতি কমানো হয়।
আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭০ জনকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়। এর মধ্যে ২১ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়। অন্যান্য হাসপাতালে নেওয়া হয় আরও অন্তত ৩০ জনকে। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে এক পরিবারের চারজন রয়েছেন। তাঁরা হলেন ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার সুজন মিয়া (৩৫), তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৩০), তাঁদের দুই ছেলে সজীব মিয়া (১৪) ও ইসমাইল মিয়া (১০)। অন্য ১১ জন হলেন কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দড়িগাঁও গ্রামের আছির উদ্দিন (৩০), মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া গ্রামের রাসেল মিয়া (২১), চানপুর গ্রামের সাইমন মিয়া (২৬), ভৈরব পৌর শহরের টিনপট্টি এলাকার বাসিন্দা সুবোধ শীল (৪৫), ভৈরব যুব উন্নয়ন কার্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ জালাল আহমেদ, ঢাকা কলেজের ছাত্র ভৈরবের রাধানগর গ্রামের আফজাল হোসেন (২৩), রানীরবাজারের সবুজ চন্দ্র শীল (৫০), শ্রীনগরের রাব্বি মিয়া, ময়মনসিংহের নান্দাইল উপজেলার মেরেঙ্গা গ্রামের হোসনা আক্তার, কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষ্মীপুরের ইমারুল কবীর (২২) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বরইছড়া এলাকার নিজাম উদ্দিন সরকার।
দুর্ঘটনার পর ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন লাগোয়া জগন্নাথপুর এলাকার লোকজন প্রথমে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। উদ্ধারকাজে অংশ নেন স্টেশনের হকাররাও। মূলত তাঁরা কোচের ভেতর থেকে আহত ব্যক্তিদের বের করে এনে হাসপাতালে পাঠান। পরে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র্যাব, ডিবি পুলিশ ও যুব রেড ক্রিসেন্টের সদস্যরা এসে কোচের ভেতর থাকা মরদেহ বের করে আনেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও উদ্ধারকাজে যুক্ত জগন্নাথপুর এলাকার জাহিদ হাসান বলেন, ‘বিকট শব্দ আর মানুষের চিৎকার কানে আসার পর ধারণা করছিলাম হয়তো ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসে দেখি ভয়াবহ অবস্থা। ভেতর থেকে অসংখ্য মানুষের চিৎকারের শব্দ আসছে। বাইরে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে পড়ে আছে অনেকে। সবার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে।’
উদ্ধারকাজ তদারকির জন্য দুই ঘণ্টা পর কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ সুপার মো. রাসেল শেখ, ভৈরব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাদিকুর রহমান, র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার মো. আলী আক্কাস ঘটনাস্থলে আসেন।
ডিসি আবুল কালাম আজাদ সাংবাদিকদের বলেন, উদ্ধারে একাধিক দলের সদস্যরা কাজ করছেন। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
পরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন স্থানীয় সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান।
বেশির ভাগ আহত ব্যক্তিকে আনা হয় ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ২০–২৫ জনকে নেওয়া হয় স্থানীয় বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে। শুরুতে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় স্বাস্থ্যকর্মীদের। প্রয়োজনীয় অ্যাম্বুলেন্সের জোগান দিতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়। চিকিৎসায় সহায়তা দেওয়ার জন্য দুর্ঘটনার দেড় ঘণ্টা পর পাশের উপজেলা কুলিয়ারচর থেকে চিকিৎসক, নার্সসহ সেবাকর্মীরা এসে যোগ দেন। কুলিয়ারচর হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধও আনা হয়। গুরুতর আহত ব্যক্তিদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকায় এবং জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা বুলবুল আহমেদ জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৭০ জনকে আনা হয়। এর মধ্যে ২১ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্যত্র পাঠানো হয়েছে।
দুর্ঘটনায় দুটি কোচ লাইন থেকে ছিটকে এক পাশে হেলে পড়ায় কয়েক শ যাত্রী একজন অন্যজনের ওপর চাপা পড়েন।
ভৈরব স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন ঢাকার সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী মো. সাদেক (২২) বলছিলেন, ভৈরব থেকে ট্রেন ছাড়ার ৫ মিনিট পর একটা শব্দ হলো। তারপর চিৎকার-চেঁচামেচি। জ্ঞান ফিরে পেয়ে সাদেক নিজেকে আবিষ্কার করলেন অনেকের ওপরে পড়ে আছেন। এরপর কোনোরকমে জানালা দিয়ে নিচে নামেন। তাঁর সঙ্গে বন্ধু নাঈমও নেমে এলেন। বেরিয়ে এসে দেখেন রক্ত আর মানুষের চিৎকার। দুর্ঘটনায় সাদেকের হাত ভেঙেছে, পায়ে আঘাত পেয়েছেন। সাদেক ও তাঁর বন্ধু বসেছিলেন ট্রেনের শেষের কোচের আগেরটিতে। ট্রেনটিতে যাত্রীতে ঠাসা ছিল বলে জানালেন সাদেক। তাঁদের কোচেই আসনবিহীন যাত্রী ছিলেন অনেক। তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না।
দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে, ২০১৮ সাল থেকে গতকাল পর্যন্ত রেল দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৩৪৫ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন আরও ১ হাজার ৩০২ জন। এ সময় রেল দুর্ঘটনা ঘটে ১ হাজার ১১৬টি।
রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রেল দুর্ঘটনার একটা বড় অংশই লাইনচ্যুতির ঘটনা। এতে প্রাণহানি কম। বেশির ভাগ প্রাণহানি হয় এক ট্রেনের সঙ্গে অন্য ট্রেনের সংঘর্ষ কিংবা রেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায়।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন বিশেষ প্রতিনিধি, ঢাকা ও নিজস্ব প্রতিবেদক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া]